জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কখনোই জমিদারপ্রথার পক্ষে ছিলেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল জমিদারির মালিক হলেও স্কুলজীবনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। এর জন্য অবশ্য তাকে স্কুলজীবনেই দেড় বছর কারাবাসে কাটাতে হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনাড়ম্বর রুচিসি্নগ্ধতা-মানবহিতৈষণা-লোকায়ত ঐতিহ্যের অনুরাগী এবং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি_ সবই তিনি মনের ভেতর লালন করেছেন তারুণ্য থেকে মৃত্যু অবধি। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজকর্মে তার আত্মনিয়োগ প্রচলিত সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে; কিন্তু নিজেকে কখনোই প্রকাশ করতে চাননি। ফলে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কথা আজ আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি। বাল্যকাল থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা আমৃত্যু সংগ্রামী এই মানুষটির নাম রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী।
১৯২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলার বালুচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী ছিলেন সমাজহিতৈষী, জ্ঞানপিপাসু ও সংস্কৃতিমনা। প্রচলিত সংসারজীবনের প্রতি অনেকটাই উদাসীন এ মানুষটির জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র ছিল অতুলনীয়। তার সংগ্রহে ছিল বিশ্ববিখ্যাত লেখকদের অসংখ্য বই। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক পেয়েছিলেন বাবার সেই ভাণ্ডার। সমাজ বিনির্মাণ এবং নানা বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানার্জনের প্রেরণা পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকেই। শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি তুলাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হলেও ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তার সাহিত্যযাত্রা শুরু হলেও ছাত্রজীবনে 'সাহিত্যিকা'র সম্পাদক হয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। রবীন্দ্রজীবনে শেষ শ্রদ্ধাবাসরের সম্মানপত্র লেখা ও পাঠ করার দায়িত্ব পালন তার সাহিত্যকীর্তির অন্যতম উদাহরণ। প্রধানত কবি হলেও রথীন্দ্রকান্ত ছিলেন গবেষক। তার 'পূর্ববাংলার মাসিকপত্র', 'ঢাকার সাময়িকীপত্রের অভ্যুদয়', 'প্রাচীন মহিলা কবি জয়ন্তী', 'পূর্ববাংলার প্রথম বিজ্ঞান সাময়িকী', 'আমার সোনার বাংলা গানের উৎস' ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন জীবনের অর্ধেক সময়। দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিবেদিত ছিলেন বলেই কাঙাল হরিনাথ, গগন হরকরা, লালন সাঁই, হালিম বয়াতি প্রমুখ লোকগায়ক ও গবেষককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার এসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাভাষার স্বনামখ্যাত পত্রিকায়। সমাজকর্মী হিসেবে তিনি নির্মাণ করেছেন অসংখ্য স্থাপনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে সংঘটিত দাঙ্গাকবলিত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, মজুদদারবিরোধী আন্দোলন, লঙ্গরখানা ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। মুর্শিদী-ভাটিয়ালি, কবিগান, জারিগান ও ভাওয়াইয়া গান তিনিই জনপ্রিয় করে তোলেন।
১৯৮৮ সালের ১৫ জুন রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
লিঙ্কন বিশ্বাস
রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী
Info Post
0 comments:
Post a Comment