রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান নাম নিয়েই ১৯৪১ সালের ২৪ মে মিনেসোটার ডুলুথে জন্ম হয়েছিল বব ডিলানের। তার বাবা-মা অ্যাব্রাম জিমারম্যান ও বেয়ট্রিস ছিলেন এলাকার ছোট্ট ইহুদি সমাজের সদস্য। সাত বছর বয়স পর্যন্ত বব ডিলন ওরফে জিমারম্যান ডুলুথেই বাস করতেন। পরবর্তীতে তার পিতা পোলিওতে আক্রান্ত হলে পুরো পরিবার হিবিং এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। শৈশবের সময়টায় মূলত রেডিওতে ব্লুজ এবং কান্ট্রি সং শুনতে শুনতেই গানের প্রতি আকর্ষণ জন্মে বব ডিলানের মনে। পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে রক অ্যান্ড রোল ধারার গানের প্রতিও ক্রমেই আকৃষ্ট হতে থাকেন ডিলান। এরই মাঝে স্কুলে পড়ার সময়ে ‘দ্য শ্যাডো ব্লাস্টার্স’ নামের একটি ব্যান্ডদল গঠন করলেও সেটি বেশিদিন টেকেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় বিভিন্ন দল আর প্রতিযোগিতায় গানের চর্চাটি ঠিকই চালিয়ে যান ডিলান। এরই মাঝে ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বব ডিলান ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা’তে ভর্তি হন এবং মিনিয়াপোলিসে বসবাস শুরু করেন। রক অ্যান্ড রোলে তার প্রথমদিককার উৎসাহ থেকে তিনি আমেরিকান ফোক সংগীতে, বিশেষত যেসব সংগীতে অ্যাকুস্টিক গিটার ব্যবহৃত হয় তার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। মূলত এ সময়ে এসেই তিনি তার নাম পাল্টে বব ডিলান নামে তার পরিচয় দেয়া শুরু করেন।
ডিলানের প্রথম দিককার গানের কথা ছিল মূলত রাজনীতি, সমাজ, দর্শন ও সাহিত্যিক প্রভাব সংবলিত। এগুলো তখনকার জনপ্রিয় ধারার কথিত নিয়মবহির্ভূত ছিল এবং এ ধারার বিপরীত হিসেবে ধরা হতো। নিজস্ব সংগীত ধারা প্রসারের পাশাপাশি তিনি আমেরিকার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংগীতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছেন। তিনি আমেরিকান লোকগীতি ও কান্ট্রি-ব্লুজ থেকে রক অ্যান্ড রোল, ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ লোকগীতি এমনকি জ্যাজ, সুইং, ব্রডওয়ে, হার্ড রক এবং গসপেলও গেয়েছেন।
আলোচিত ব্যান্ডদল বিটলস্-এর সদস্য হিসেবে তার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আরো অনেকের নামই। কিন্তু সময়ের পালাবদলে এক বব ডিলান যেভাবে মানবতাকামী মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন অমনতর সৌভাগ্য আর কারোরই হয়নি। আর গানের মানুষ বব ডিলানের সাথে তার ব্যক্তিমানুষের এই ভাবনাই একটি বড় সময়জুড়ে বব ডিলানকে পরিণত করেছে পাশ্চাত্য সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তিতে। নানা সময়ে তার করা টুগেদার থ্রো লাইফ, ডিজায়ার, নিউ মর্নিং, শর্ট অব লাভ কিংবা ওয়ার্ল্ড গন রং শিরোনামের গানগুলো যেমন তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে তেমনি বব ডিলান গণমানুষের আশীর্বাদধন্য হয়েছেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবেও। মূলত ষাটের দশকে আমেরিকার নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনে যে ক’জন শিল্পীর গান অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তাদের মধ্যে বব ডিলান ছিলেন প্রথম সারির একজন। ওয়াশিংটন ডিসিতে জনমানুষের নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতার মিছিলে জন বায়েজ ও পিট সিগারদের সাথে গান গেয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাম্যবাদ আর ঐক্যের প্রতীক। এছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সারা বিশ্বের দৃষ্টি ফেরানো আলোচিত কনসার্ট ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর অন্যতম অংশীদার ছিলেন বব ডিলান।
ডিলন সাধারণত গিটার, কিবোর্ড এবং হারমোনিকা বাজিয়ে গান করেন। ১৯৮০ দশক থেকে কিছু সংগীতজ্ঞকে সাথে নিয়ে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন সংগীত ভ্রমণ করে থাকেন, যা তার ভাষায় ছিল ‘নেভার এন্ডিং টুর’। তিনি নানা সময়ে প্রধান অনেক শিল্পীর সাথে একত্রে কাজ করেছেন। যদিও তার ক্যারিয়ারে গায়ক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত এবং গীতিকার হিসেবেই তার অবদানকে বেশি মূল্য দেয়া হয়। সংগীতে তার নানাবিধ অবদানের কারণে তিনি গ্র্যামি, গোল্ডেন গ্লোব এবং অ্যাকাডেমি পুরস্কার জিতেছেন এবং রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম, ন্যাশভিল সংরাইটার্স হল অব ফেম ও সংরাইটার্স হল অব ফেম-এ তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশিত বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তার নাম রয়েছে এবং ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন প্রকাশিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ গায়কের তালিকায় দ্য বিটলসের পর বব ডিলন দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেন। এছাড়া পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী এই গায়ক বেশ কয়েকবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছেন। অন্যদিকে গত বছরের ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত হয় বব ডিলানের ৩৩ তম ও সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘টুগেদার থ্রো লাইফ’।
বব ডিলান
Info Post
0 comments:
Post a Comment