হযরত উম্মে আয়মান (রাঃ) তার আরও একটি নাম নাজদিয়া। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ উম্মে আয়মান বলেই সর্বত্র উল্লেখ করেছেন। তার পিতার নাম ফররুক ইবনে মাসরুক। মাতার নাম উয্রা। তিনি সিরিয়া রাজ্যের অন্তর্গত রামাল্লা শহরের অধিবাসী গাফতানী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। রামাল্লা থেকে পিতার সাথে উম্মে আয়মান দামেস্ক যাওয়ার পথে দস্যু কর্তৃক ফররুকের কাফেলা অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। ফররুকসহ আরো কয়েকজনকে আহত এবং নিহত করে সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়। কাফেলার সাথে থাকা বালক-বালিকা এবং স্ত্রী লোকদেরকে দস্যুদল খোলা বাজারে পণ্যের মত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের কাছে বিক্রি করে দেয়। হযরত উম্মে আয়মান ছিলেন তাদের মধ্যে এগার-বারো বছরের এক বালিকা।
প্রিয় নবী (সাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়া থেকে বাণিজ্য করে ফেরার পথে দোমাতুল জন্দন থেকে ৮০ দিনারে ক্রয় করে আনেন উম্মে আয়মানকে। এর এক বছর পর বিবি আমেনার সাথে আবদুল্লার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর স্বামী আবদুল্লাহ উম্মে আয়মানকে দাসী হিসাবে বিবি আমেনার কাছে সোপর্দ করেন। দাসীর খেদমতে বিবি আমেনা অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে দেন। আমেনা বললেন, "আয়মান, তুমি তো এখন আযাদ। যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যেতে পার।" তিনি জবাব দিলেন, "এমন দয়ালু মনিব ছেড়ে যাবই বা কোথায়? এই পৃথিবী আমার অপরিচিত। তাছাড়া দস্যুর কবলে পড়ে আমার পিতা-মাতা নিরুদ্দেশ। বাইরে বের হলে আবার আর একজন দাসী হিসাবে ব্যবহার করবে। আমি যাবো না। যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আপনার সেবিকা হিসাবেই থাকতে চাই।" আবদুল্লাহ অত্যন্ত খুশি হলেন আয়মানের কথা শুনে এবং বললেন, "বেশ তো তোমার মন চাইলে তুমি থাকতে পার।" উম্মে আয়মান (রাঃ) সেদিন থেকে নবী পরিবারের সদস্যা হিসাবে বসবাস শুরু করেন। বিবি আমেনা উম্মে আয়মানকে ছোটবোন হিসাবেই দেখতেন। প্রিয় নবী (সাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহর মৃত্যুর ছয় বছর পর মা আমেনা যখন স্বামীর কবর জিয়ারতের ইচ্ছা করেন তখন আব্দুল মোত্তালিব তার সঙ্গিনী হিসাবে উম্মে আয়মানকেও সাথে পাঠালেন। বিবি আমেনার ইন্তেকালের পর শিশু নবীকে তার দাদার কাছে পৌঁছে দেন উম্মে আয়মান। তার সেবা-যত্নে প্রিয় নবী (সাঃ) শৈশব ও কৈশোর জীবন পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন। প্রিয় নবী (সাঃ) এর ২৫ বছর বয়সে যখন বিবি খাদিজার সাথে বিয়ে হয়েছিল তখনও উম্মে আয়মান মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত উম্মে আয়মানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। মাতৃভক্তির চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গিয়েছেন প্রিয় নবী (সাঃ)।
তিনি তার পালিত পুত্র যায়েদ ইবনে হারেসার সাথে উম্মে আয়মানের বিবাহ দিয়ে ছিলেন। চল্লিশ বছর বয়সে প্রিয় নবী (সাঃ) নবুয়াত লাভের পর হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) প্রথম মুসলমান এবং উম্মে আয়মান হলেন দ্বিতীয় মুসলমান। হযরত উম্মে আয়মানের সন্তান হযরত উসামা (রাঃ)কে আল্লাহর নবী অত্যন্ত ভালবাসতেন। ‘আল কাসওয়া’ নামক উটের পিঠে উসমাকে চড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রিয় নবী (সাঃ) ঘুরে বেড়াতেন, কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে নবীজি জবাব দিতেন এ আমার ছোট ভাই উসামা। জনগণ বলতেন হে নবী! আমরাতো জানতাম আপনার কোন ভাই নেই। উত্তরে নবী (সাঃ) বলতেন, হ্যাঁ তোমাদের কথাও ঠিক। উম্মে আয়মান আমার মাতৃস্থানীয় আর তার গর্ভজাত সন্তান আমার ভাই। নবী পরিবারের সাথে উম্মে আয়মানও মদিনায় হিজরত করেছিলেন। ওহুদ যুদ্ধের সময় উম্মে আয়মান পানির মশক পিঠে নিয়ে পিপাসার্ত মুসলিম মুজাহিদদের পানি পান করাতেন। মুসলিম সৈন্যগণ যখন ছত্রভঙ্গ হয়েছিলেন তখন উম্মে আয়মান পালন করেছিলেন সাহসী এক সৈনিকের ভূমিকা। ওহুদের যুদ্ধে হযরত উম্মে আয়মানের শরীরে ২৬টি তীরের এবং চারটি তলোয়ারের আঘাত লেগেছিল। এরপর থেকে ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে উম্মে আয়মান (রাঃ) সেবিকা হিসাবে যেতেন। বায়তুল মাল থেকে প্রিয় নবী (সাঃ)-এর পরিবারবর্গ যে ভাতা পেতেন সদস্যা হিসাবে উম্মে আয়মানকেও এক অংশ দিতেন।
বিদায় হজ্বের সময়ও হযরত উম্মে আয়মান প্রিয় নবী (সাঃ) এর সাথে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের সময় বালকপুত্র উসামাকে নবীজীর (সাঃ) খাদেম হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। একজনে বলেছিলেন তোমার একমাত্র পুত্র যদি কাফেরদের হাতে শহীদ হয়? উত্তেজিত কণ্ঠে হযরত উম্মে আয়মান জবাব দিলেন," আল্লাহর ইচ্ছা হলে শহীদ হবে, তাতে তোমার আমার কি করার আছে? আল্লাহ যদি আমাকে একটি সন্তান না দিয়ে এক হাজার সন্তান দিতেন, তাহলে প্রতিটি সন্তান আল্লাহ ও তার রাসূলের পথে কোরবান করে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।"
হযরত হাসান (রাঃ) এর খেলাফতকালে পবিত্র জুমুআর দিন রাতে নিজ ঘরে পবিত্র কুরআনের সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াতরত অবস্থায় মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। ইন্তেকালের সময় তার বসয় হয়েছিল ১০৫ বছর। জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়।
0 comments:
Post a Comment