Breaking News
Loading...
Monday, July 13, 2020

সমগ্র ভারতবর্ষের চিকিৎসাক্ষেত্রে নারীদের আজকের যে সাফল্য ও অবদান, তার সূচনা ঘটেছিল একজন জ্ঞানী, চৌকস ও অসম সাহসী নারী চিকিৎসকের হাত ধরে।

শুধু চিকিৎসাক্ষেত্রেই নয়, তিনি ছিলেন নারীদের উচ্চশিক্ষার একজন অগ্রদূত। সেই মহীয়সী নারী হলেন কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ভারতবর্ষের প্রথম দুই নারী গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে একজন এবং ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক। এটি সেই সময়কার কথা, যে সময়ে নারীশিক্ষার কিছুটা প্রসার ঘটলেও তা কেবল বিদ্যালয় আর ‘অন্তঃপুরের শিক্ষার’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং, সমালোচনা, নিন্দা, গঞ্জনা ,হুমকি প্রভৃতি যে কাদম্বিনী দেবীর চলার পথকে কন্টকাকীর্ণ করে তুলেছিল, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, শত বাধা বিপত্তি ও সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে মহীয়সী নারী আজ নারীদের উচ্চশিক্ষা ও ডাক্তারি পড়ার পথকে সুদূরপ্রসারী করে তুলেছেন, তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া আমাদের অবশ্যকর্তব্য।

জন্ম


দিনটি ছিল ১৮ই জুলাই, ১৮৬১ সাল। পশ্চিমবঙ্গের বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন কাদম্বিনী বসু। পিতা ব্রজকিশোর বসু পূর্বে বরিশাল নিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভাগলপুরে এসে বসবাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের একজন অগ্রবর্তী নেতা। কাদম্বিনীর যখন দু বছর বয়স, সেই সময় অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে ব্রজকিশোর বসু , অভয়চরণ মল্লিক, শিবপ্রসাদ শাস্ত্রী সহ নারী স্বাধীনতা সমর্থনকারী আরো অনেকের প্রচেষ্টায় ভাগলপুরে দেশের প্রথম মহিলা সমিতি ‘ভাগলপুর মহিলা সমিতি’ স্থাপিত হয়। পিসতুতো দাদা মনমোহন ঘোষ কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিষ্টার। তিনিও ছিলেন নারীশিক্ষা প্রসারের অন্যতম কাণ্ডারী। ছোটবেলা থেকেই পিতা ও দাদার আদর্শ নিজের মধ্যে লালন করতে থাকেন কাদম্বিনী দেবী।

প্রাথমিক শিক্ষা


সেই সময় বঙ্গে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য খুব কম সংখ্যক বিদ্যালয় ছিল। তাই মনমোহন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় , দুর্গামোহন দাসের মতো নারী স্বাধীনতাকামীগণ মেয়েদের শিক্ষার জন্য মানসম্মত স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সৌভাগ্যবশতঃ অ্যানেড অ্যাক্রয়েড নামে এক বিদেশিনী শিক্ষয়িত্রীকে তাঁরা সহযোগী হিসেবে পেলেন। সকলের একান্ত প্রচেষ্টায় অবশেষে ১৮৭৩ সালে ২২ নং বেনিয়াপুকুর লেনে স্থাপিত হয় ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়। এটি ছিল মূলতঃ একটি বোর্ডিং স্কুল, যেখানে মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিলিতি কায়দায় কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া, রান্নাবান্না, হাতের কাজ প্রভৃতিও শেখানো হতো। ১৩ বছর বয়সী কাদম্বিনীর স্কুলশিক্ষার পদার্পণ হয় এখানেই।

অ্যানেড অ্যাক্রয়েডের কঠোর তত্ত্বাবধানে বেশ ভালোই চলছিল স্কুল । কিন্তু,পরে তিনি বারাসাতে কর্মরত আইসিএস সদস্য হেনরী বেভারীজকে বিয়ে করেন এবং স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আড়াই বছরের মাথায় স্কুলটি উঠে যায়। ফের ১লা জুন, ১৮৭৬ সালে, ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ নামে স্কুলটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাঙালি মেয়েদের প্রথম ইংলিশ বোর্ডিং স্কুল।

কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার টানাপোড়েনে এই স্কুলটিরও উঠে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। শেষ পর্যন্ত ,১৮৭৮ সালে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়কে বেথুন স্কুলের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। কাদম্বিনী প্রথম নারী হিসেবে এ স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। মাত্র ১ নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ না পেলেও সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হন। খোদ লর্ড লিটন (তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল) এর প্রশংসা ও লেডি লিটনের হাত থেকে সার্টিফিকেট ও পুরস্কার গ্রহণ করেন।

কলেজজীবন ও সমাবর্তন


এত কিছুর পরেও সংশয় তার পিছু ছাড়ে না। কারণ, তখন নারীদের পড়াশোনার জন্য কোনো আলাদা কলেজ ছিল না। প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোতেও তাদের পড়াশোনার কোনো সুযোগ ছিল না। এদিকে কাদম্বিনীও জেদ ধরলেন ,তিনি ফার্স্ট আর্টস পড়বেন। বেথুন কমিটি পড়লো এক মহা ঝামেলায়। এখন কি করা যাবে ! তাঁরা কটক কলেজের প্রফেসর শশীভূষণ দত্তকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলেন। শত ঝামেলা, বাধা-বিপত্তির পর অবশেষে Sir A W Croft, Director of Public Instruction for Bengal, তাঁর শিক্ষা রিপোর্টে জানালেন,

"কাদম্বিনীর জন্যই ব্রিটিশ সরকার বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করবে। "

এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হলো বেথুন কলেজ। একজন ছাত্রী, একজন লেকচারার ও একজন বৃটিশ সুপারিনটেনডেন্টকে নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হলো।

তবে কাদম্বিনীরও আগে প্রাইভেটে এন্ট্রান্স দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী বসু। পরে তিনি কলকাতা ফ্রি চার্চ নর্মাল স্কুলে পড়াশোনা করে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন । কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী দুজনেই ১৮৭৯ সালে এফ এ পাশ করেন । তাঁদের যুগ্ম সাফল্যে বেথুন কলেজে বি এ পড়ানোর দ্বার উন্মোচিত হয়। বি এ তে ভর্তি হওয়ার সময় চন্দ্রমুখী বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্স এবং কাদম্বিনী গণিত। দুই নারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে বেথুন কলেজে বি এ পড়ানো চলতে লাগলো ।এ যেন পুরুষতান্ত্রিক গোঁড়া সমাজে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টির অক্লান্ত প্রয়াস। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে বিএ পাশ করে সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেন। নারীদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারকে সমূলে উ্ৎপাটিত করলেন।তাঁদের সমাবর্তনও হয়েছিল দেখার মতো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এতো লোকসমাগম হয়েছিল যে, পুলিশিকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভীড় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ট্রামলাইন পর্যন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কবি হেমচন্দ্র দুই বিদুষীকে লিখে ফেললেন তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কবিতাটি

কে বলেরে বাঙালির জীবন অসার
সৌরভে আমোদ দেখ আজ কিবা তার ।
বাঙ্গালীর হৃদয়ের যতনের ধন ,
তার মাঝে দেখ ভাই দুইটি রতন।
রজনী করিতে ভোর উজলী গগন
আশার আকাশে উঠি জ্বলিছে কেমন-
ধন্য বঙ্গনারী ধন্য সাবাসি তুহারে
ভাসিলো আনন্দ ভেলা কালের জোয়ারে।

কিন্তু এখনেই তাঁরা থামবার পাত্র নন ; আরো উচ্চশিক্ষিত হতে চান । চন্দ্রমুখী বেথুনেই এম এ পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবার কাদম্বিনী তাঁর জীবনের সবচাইতে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি ঠিক করলেন ,ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। মেয়ে মানুষ ডাক্তার! তৎকালীন সমাজে এ ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু কাদম্বিনী নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। শুরু হলো এক লড়াই ও প্রতিরোধের ইতিহাস।

মেডিকেলে পড়ার সংগ্রাম

১৮৮১ সালে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার আবেদন করেন। শিক্ষা অধিকর্তা এতে আগ্রহী হলেও মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল এ ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপই করেন নি। হাল ছাড়েন নি কাদম্বিনী। দুই বছর পর পুনরায় আবেদন করেন । ডি পি আই মেডিকেল কাউন্সিলকে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চান কি উত্তর দেবেন। এর মধ্যেই ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১২ই জুন কাদম্বিনী বসু তার চেয়ে প্রায় ১৮ বছরের বড় দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ; যা তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজে ঝড় তুলে দিয়েছিল। বিয়ের কয়েক দিন পরই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পান তিনি।কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশ তা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাদের মুখপাত্র ছিলেন স্যার রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র । শিক্ষিত ও বিলিতি পরিবারের জামাই হয়েও তিনি ছিলেন অতি রক্ষণশীল এবং স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী। তিনি কাদম্বিনীর মেডিকেলে পড়ার ঘোর প্রতিবাদ করেছিলেন । শুধু তাই নয় , তিনি তাঁর ‘মেডিসিন’ কোর্সে মৌখিক পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে এক নম্বরের জন্য কাদম্বিনীকে ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন।


অবশ্য সে সময় কেবল বঙ্গপ্রদেশ নয়, বম্বেতে এমনকি বিদেশেও মেয়েদের ডাক্তারি পড়াকে হীন দৃষ্টিতে দেখা হতো। তাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য ক্লাসে অত্যন্ত অশালীন ভাষায় মানবদেহের বর্ণনা দেওয়া হতো। তবে কাদম্বিনীকে ঠিক কি ধরণের অপমান সহ্য করতে হয়েছিল ,তা জানা যায় নি। কিন্তু যে কাদম্বিনীর ‘জেদের’ বশে বেথুন কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল , বিএ পরীক্ষায় পাশ করে যিনি সারাদেশে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন ,সেই কাদম্বিনী কে ‘ব্যাচেলর অব মেডিসিন’ অর্থাৎ এম বি ডিগ্রি দেওয়া হয় নি! এর মূল হোতা ছিলেন সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিটি । চন্দ্রবাবু ‘মেডিসিন’ বিষয়টি পড়াতেন। এ বিষয়ের আরেকজন অধ্যাপক ও পরীক্ষক ছিলেন স্যার জে এম কোটস। তিনি এ অন্যায় ব্যাপারটি বুঝতে পেরে সিণ্ডিকেটের সাথে আলোচনা করেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি’ সংক্ষেপে এলএমএস সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সেখানেও বাগড়া দেন স্যার রাজেন্দ্রচন্দ্র । দুই বছর এলএমএস পড়ার পর ফাইনালে ফের ‘মেডিসিন’ এ তাঁকে ফেল করানো হয়। সিনেটের অনুরোধে পূনর্মূল্যায়ন করা হলো, তাতেও তাঁকে পাশ করানো হলো না। তখন অধ্যক্ষ কোটস নিজ অধিকারবলে কাদম্বিনীকে 'গ্র্যাজুয়েট অব দ্যা মেডিকেল কলেজ অব বেঙ্গল’ সংক্ষেপে জিএমসিবি ডিগ্রি দেন এবং ইডেনে মেডিকেল কলেজে তাঁর কাজের ব্যবস্থা করেন।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবন


ইডেনে মেডিকেলে এম বি কিংবা এলএমএসের সার্টিফিকেট না থাকার কারণে সেখানে তাঁকে নার্সের মর্যাদা দেওয়া হতো। রোগ নির্ণয় কিংবা অপারেশন করতে দেওয়া হতো না। বাধ্য হয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা নেন তিনি। প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। মাঝে কিছুদিন লেডি ডাফরিন হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। কিন্তু ডাক্তারি ডিগ্রি না থাকাটা তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচকদের মুখরোচক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় তিনি বিদেশে গিয়ে ডাক্তারি ডিপ্লোমা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিজের ছোট ছোট সন্তানদের প্রথম পক্ষের মেয়ে বিধুমুখী ও তাঁর স্বামী উপেন্দ্রকিশোরের কাছে রেখে বিলেত যাত্রা করেন। তিনি এডিনবরায় ক্লাস করতেন। স্বল্প সময়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে অর্জন করলেন একের পর এক ডিগ্রিঃ LRCP, LFCS, LFPC. এছাড়াও স্কটিশ কলেজ থেকে তিনটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। সাফল্যমন্ডিত হয়ে দেশে ফেরার পর ‘বামাবোধিনী’ , ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’ এর মতো কাগজগুলো তাঁর তুমুল প্রশংসা করে। কিন্তু হায়! এবারও এই পোড়া দেশে নিজের যোগ্যতায় কোনো পদ কিংবা চাকুরি পান নি। প্রথমদিকে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তারের চাকরি করতেন । কিছুদিন পর সেখান থেকে ইস্তফা নিয়ে পুরোপুরি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। খুব দ্রুত পসার জমে উঠে । দিকে দিকে তাঁর চিকিৎসার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সবার কছে পরিচিত হয়ে উঠেন ‘ডাক্তার কাদম্বিনী’ হিসেবে।

পেশার দিক থেকে কাদম্বিনী ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাঁর একটা উদাহরণ দেই। স্বামী দ্বারকানাথ যেদিন মারা যান, সেদিনও তার কাছে কলকাতার এক জমিদার বাড়ি থেকে বাচ্চা প্রসব করানোর জন্য ‘কল’ আসে।স্বভাবতই যে কোনো শোকগ্রস্ত ডাক্তারের ক্ষেত্রে ‘কল’ টি প্রত্যাখ্যান করার কথা। কিন্তু তিনি তা করেন নি। সকালের স্বামীহারা কাদম্বিনী বিকালে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সেখানে রওনা দেন। তাঁর এরূপ কর্মকাণ্ড দেখে আত্মীয়রা যথেষ্ট অবাক ও অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু তিনি তাঁদের বললেন, “ যে গেছে ,সে তো আর ফিরে আসবে না। যে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে, তাকে তো আনতে হবে।“ এটি ছিল কাদম্বিনীর কর্মনিষ্ঠার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

আরো একটা ঘটনা বলি, একবার নেপালের রাজার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো চিকিৎসাতেই তাঁর রোগ সারছিল না ; একেবারে মরোমরো অবস্থা। উপায় না দেখে শেষ চেষ্টা হিসিবে কাদম্বিনীকে কল করা হলো। তাঁর ওষুধেই রাজমাতা সুস্থ হয়ে উঠলেন। এতে রাজা খুব খুশি হন। পুরস্কার হিসেবে তিনি কাদম্বিনীকে প্রচুর অর্থ, সোনার গহনা, রূপোর বাসন সহ অনেক মূল্যবান উপহার প্রদান করেন। সাথে একটি সাদা রঙের টাট্টু ঘোড়াও দিয়েছিলেন। সেই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে তিনি কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে রোগী দেখতে যেতেন। আশ্চর্য্যের বিষয়, গাড়িতে চড়ার সময়টুকুতেও তিনি অলস হয়ে বসে থাকতেন না। অনবরত লেস(শাড়ি, ফ্রক, পাঞ্জাবীর উপর তৈরী নকশা বিশেষ) বুনে যেতেন। অসামান্য দক্ষতায় অপূর্ব সব লেসের নকশা তৈরী করতেন।

রাজনৈতিক জীবন


কাদম্বিনী বসুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশিও তথ্য পাওয়া যায় না। ১৮৮৯ সালে তৎকালীন বোম্বেতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে নির্বাচিত ৬ জন নারীর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পরের বছর কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। পরবর্তীকালে গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। এছাড়াও ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন। ১৯১৪ সালে কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ তৎকালীন সময়ে আসামের চা বাগানের শ্রমিক শোষণের তীব্র নিন্দা জানান। কাদম্বিনী স্বামীর এরূপ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন। কবি কামিনী রায়ের সাথে তিনি বিহার ও ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্ত করার জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন। অন্যদিকে, তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ বয়কট আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
দ্বারকানাথের সাথে বিবাহ ও সামাজিক বাধা

আগেই বলেছি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও রক্ষণশীল সমাজে কাদম্বিনীর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। শিক্ষা ও কর্মজীবনে তাঁকে অজস্র নিন্দা আর কটাক্ষ সইতে হয়েছে। এমনকি, তাঁর বৈবাহিক জীবনও সমালোচকদের শকুনি দৃষ্টির আড়াল হতে পারে নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এবার কাদম্বিনীকে সমালোচনার কাঠগোড়ায় দাঁড় করালেন শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা ব্রাহ্মগণ। কাদম্বিনী যখন দ্বারকানাথের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর আর দ্বারকানাথের ৩৯ বছর। দ্বারকানাথ শুধু কাদম্বিনীর শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন বিপত্নীক ও দুই সন্তানের জনক। এহেন বিবাহে ব্রাহ্মসমাজ নিতান্তই অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। এমনকি, নারীমুক্তি আন্দোলনের নেতা ও ‘’বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ এর উদ্যোক্তাদের একজন স্বয়ং শিবপ্রসাদ শাস্ত্রীও এ বিয়েতে উপস্থিত হননি।

কিন্তু কাদম্বিনী-দ্বারকানাথের দাম্পত্য জীবন ছিল ব্যতিক্রম। উদারমনস্ক, বুলিসর্বস্ব না হয়ে সত্যিকারের নারী স্বাধীনতার আদর্শধারী দ্বারকানাথকে কাদম্বিনী বেশ পছন্দই করেছিলেন।তবে তাদের এ বিবাহ নিয়ে বেশ কটাক্ষ শুনতে হয়েছে।

ব্রাহ্মসমাজের এই ঘৃণা কতটা চরম পরিণতি ধারণ করছিল, একটি ঘটনা ব্যাখ্যা করলে তা বোঝা যাবে। সে সময়ে, সাময়িক ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন ছেপে স্বচ্ছন্দে ডা. কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’ (সোজা বাংলায় ‘বেশ্যা’) বলে অভিহিত করেন। সেই কার্টুনে দেখানো হয়েছিলো, ‘বারবণিতা’ কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাকে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কি জঘন্য মানসিকতা ! এহেন অপমানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিলেন কাদম্বিনী-দ্বারকানাথ দম্পতি। কোর্টে মামলা করলেন তাঁরা। রায়ে মহেশ্চন্দ্র পালকে কাদম্বিনীর অপমানের দণ্ড হিসেবে ১০০ টাকা জরিমানা ও সেই সাথে ৬ মাসের জেল দেওয়া হয়। তৎকালীন পুরুষশাসিত রক্ষণশীল সমাজে এ ধরণের জঘন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে এরূপ দৃঢ় পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

পারিবারিক জীবন


দ্বারকানাথের সাথে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর যখন বিয়ে হয়, তখন দ্বারকানাথ এক মেয়ে ও এক ছেলের পিতা। মেয়ে বিধুমুখী প্রায় কাদম্বিনীরই বয়সী। ছেলে সতীশচন্দ্র ছিলো রিকেটস রোগী ও মানসিক প্রতিবন্ধী।কাদম্বিনী ছেলের চিকিৎসার সমস্ত ভার বহন করেন। ছেলেকে সুস্থ করতে তিনি নিজ হাতে সোনা ব্যাঙের ঝোল রেঁধে তাঁকে খাওয়াতেন। বিমাতা হলেও মেয়ের সাথে তাঁর মধুর সম্পর্ক ছিল । মূলতঃ মায়ের সহযোগীতায় বিধুমুখী ভার্জিনিয়ায় এম বি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিলেতে ডিপ্লোমা করতে যাওয়ার সময় কাদম্বিনী নিজের বাকি সন্তানদের বিধুমুখী ও তাঁর স্বামী উপেন্দ্রকিশোরের তত্ত্বাবধানে রেখে যান।
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়

শোনা যায়, তাঁদের গুরুপ্রসাদ লেনের বাড়িতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবের গান শেখাতে আসতেন। গান তুলতে যে যুবকেরা আসতেন, তাদের মধ্যে নরেন্দ্র দত্ত, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। উপেন্দ্রকিশোর সে উৎসবে বেহালা বাজাতেন,। ক্রমে রায় পরিবার ও গাঙ্গুলি পরিবারের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ও পরে আত্মীয়তা গড়ে উঠে; যার পরিণতি হলো বড় মেয়ে বিধুমুখীর সাথে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বিবাহ। উল্লেখ্য, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুর্দা।
স্ত্রী বিধুমুখীর সাথে উপেন্দ্রকিশোর ও তার পরিবার

কাদম্বিনীর ব্যক্তিত্ব


বলা হয়ে থাকে, কাদম্বিনী দেবী বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীদের চাইতেও অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন। একাধারে চিকিৎসক, নারী জাগরণ কর্মী, রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিন ছিলেন সূচিকর্ম নিপুণা এবং গৃহকর্মে অত্যন্ত পটু। সবসময় নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতেন ।তাঁর বাড়ির নিয়ম ছিল, ইমার্জেন্সি বাদে কেউ রাত নটার পর ঘরে ঢুকলে তাকে রাতের খাবার খেতে দেওয়া হবে না। ব্রাহ্মসমাজের রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে শান্তাদেবী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন,

'তিনি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবাদিতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কাদম্বিনী ভাল ডাক্তার ছিলেন এবং খুব কড়া কড়া কথা বলতেন, অপ্রিয় সত্য বলতে ভয় পেতেন না। নিজের ছেলেমেয়েদেরও বাদ দিতেন না। আবার একই সঙ্গে ছিলেন স্নেহময়ী, যত্নশীলা মা ও দিদিমা।'

অন্যদিকে আমেরিকের ইতিহাসবিদ ডেভিড কফের মতে,

"গাঙ্গুলীর স্ত্রী কাদম্বিনী তাঁর সময়ের সবচেয়ে সফল এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সব বাধার উর্ধ্বে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তার এই ক্ষমতা তাকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে।"

জিএমসিবি পদক পাওয়ার খবর পেয়ে খোদ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেন

“ কে এই মিসেস গাঙ্গুলি, আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এই তরুণী বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটো জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!”

এই ছিলেন আমাদের কাদম্বিনী বসু।


মৃত্যু


কাদম্বিনী মৃত্যুর দিনটিও বেশ মনে রাখার মতো। এক আশ্চর্য্ ঘটনা ঘটেছিল সে সময়। দিনটি ছিল ৩রা অক্টোবর, ১৯২৩ সাল। সকাল সকাল গুরুপ্রসাদ লেনের বাড়ি থেকে ফিটন গাড়িতে চেপে হাসপাতালে গিয়েছিলেন এক জটিল অস্ত্রোপচার করার জন্য । এটি ছিল তাঁর কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কেননা, তখন লোকের মুখে মুখে রটে গিয়েছিলো , কাদম্বিনীর আর অপারেশনের হাত নেই। যাই হোক, অসামান্য দক্ষতায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে তিনি অপারেশনটি শেষ করেন। বাড়ি ফিরলেন দুপুরে। শরীর ক্লান্ত হলেও খুবই তৃপ্ত ছিলেন তিনি। পুত্রবধূ সরলাকে ডেকে বললেন,

“আজকের অপারেশন দেখলে আর কেউ বলতে পারবে না যে, ডাক্তার গাঙ্গুলীর আর অপারেশনের হাত নেই।“

তারপর সরলাকে খাবার বাড়তে বলে স্নান করতে গেলেন। খাবারের থালা সাজিয়ে নীচের তলায় সরলা অনেকক্ষণ বসে আছেন। শাশুড়ি আসছেন না দেখে দোতলায় তাঁর শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখেন, বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। হার্ট অ্যাটাক! মুহূর্তে নিস্পন্দ হয়ে গেলেন।

পতন হলো বাংলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের।কাজ করতে করতে নীরবেই বিদায় নিলেন নারীদের পথচলার আলোর দিশারী।

এখনো অনেকে কাদম্বিনীকে ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক উপাধি দেওয়ার ঘোর বিরোধী। যুক্তি হিসেবে তারা কাদম্বিনীর এম বি কিংবা এলএমএস ডিগ্রি অর্জন না করা এবং জিএমসিবি ডিগ্রির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯০৬ সাল অবধি কলকাতা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ডিগ্রি জিএমসিবি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল; যদিও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে ক্ষমতা অপসারণ করে। সুতরাং, ১৮৮৬ সালে জিএমসিবি ডিগ্রি ছিল সম্পূর্ণ বৈধ। এরপরেও অনেকের মনে খচখচানি থেকেই যায়। থাকুক না, কি আসে যায় তাতে? যে নারী শত অবহেলা, শত যন্ত্রণা উপেক্ষা করে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা এবং ডাক্তাররূপে মানুষের সেবা প্রদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন, কোনো সমালোচনাই তাঁর কীর্তিতে কালিমা লেপন করতে পারে না। আজ একবিংশ শতাব্দীতেও এই মহীয়সী নারী ইতিহাসের পাতায় চিরঅম্লান, চির স্মরণীয়।

লিখেছেন: অমিত চৌধুরী

0 comments:

Post a Comment