মণি সিংহ। বাংলাদেশের আপোসহীন কমিউনিস্ট নেতা। সাধারণ মানুষের কাছে কমরেড মণি সিংহ নামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন মার্কসবাদ লেনিনবাদের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল একজন খাঁটি কমিউনিস্ট। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন সারাজীবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন,গণতন্ত্র কায়েম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মণি সিংহ-র জন্ম নেত্রকোণা [তৎকালীন ময়মনসিংহ] জেলার দুর্গাপুরের সুসং-এ ১৯০১ সালের ২৮ জুন। তার পিতা কালীকুমার সিংহ ছিলেন, বিপুল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী। তার যখন আড়াই বছর বয়স, সে সময় পিতার মৃত্যু হলে বিধবা মা’র সাথে মামার বাড়িতে আসেন এবং সেখানে বেড়ে ওঠেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষালাভের জন্য কলকাতা গমন করেন। ১৯১৪ সালে অনুশীলন দলে যোগদান করেন এবং এক দশক পর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। ১৯২৫ সালে মার্কসবাদে দীক্ষিত ও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৮ সালের কলকাতার মেটিয়াবুরুজে কেশরাম কটন মিলে শ্রমিকদের ১৩ দিনব্যাপী ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায় করেন। ১৯৩০ সালের ৯মে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন, অতঃপর-জেল অন্তরীণ প্রভৃতি ভোগের পর ১৯৩৭ সালের নভেম্বরে মুক্তি পেয়ে সুসং চলে যান। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অন্যতম সংগঠক ও অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
দেশ বিভাগের পর ময়মনসিংহ জেলার হাজং কৃষকদের নিয়ে আবার টংক আন্দোলন শুরু করেন মণি সিংহ। পরবর্তীতে এ আন্দোলন সশস্ত্র রূপ ধারণ করে। ১৯৫১ সালে টংক প্রথা বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তার ওপর হুলিয়া জারি ও তার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে, একটানা বিশ বছর আত্মগোপন অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা করেন।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে মণি সিংহ পার্টির(সিপিবি) সভাপতি নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে সমাসীন ছিল। কেবল উপমহাদেশ নয়, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের লড়াই-সংগ্রামেও তাঁর এবং তাঁর পার্টির সমর্থন ও কর্মসূচি ছিল।আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী এই রাজনীতিবিদ বিশ্বের প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বর্হিবিশ্বে সম্মানিত হয়েছেন। 'শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজপ্রগতির সংগ্রামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রী সুদৃঢ়করণে' অবদানের জন্য মণি সিংহকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারে 'অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ অব পিপলস' পদকে ভূষিত করা হয়। ('মণি সিংহ সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ অব পিপলস-এ ভূষিত', সাপ্তাহিক একতা, ঢাকা, ১-৭ আগস্ট ১৯৮০) কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন নয় বুলগেরিয়া (ডিমিট্রভ পদক) এবং চেকোশ্লোভাকিয়া সরকারও তাঁকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে।১৯৭৫ সালের ৭ জুন তার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তৎকালীন সরকারের বাকশাল (কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ)-এ একীভূত হয়। ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর সিপিবি পুনরুজ্জীবিত হয় এবং তৎকালীন সরকারের সংস্কারমূলক কর্মসূচি তথা খালকাটা, নদী খনন ইত্যাদির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের (আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি) দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়। ১৯৮১ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের পক্ষে প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। সামরিক প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী অবস্থায় জীবনযাপন করেন।অবশেষে ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহ ঢাকায় পরলোকগমন করেন।
তথ্যঃ ইত্তেফাক
0 comments:
Post a Comment