Breaking News
Loading...
Saturday, December 26, 2009

শ্রীনিবাস রামানুজন (ডিসেম্বর ২২, ১৮৮৭ – এপ্রিল ২৬, ১৯২০) অসামান্য প্রতিভাবান একজন ভারতীয় গণিতবিদ। খুব অল্প সময় বাঁচলেও তিনি গণিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে গেছেন। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায় অনেক নতুন উপপাদ্য প্রমাণ করেন। তাঁর রেখে যাওয়া নোটবুক বা ডায়েরি হতে পরবর্তীতে আরও অনেক নতুন সমাধান পাওয়া গেছে।

রামানুজন ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২২ শে ডিসেম্বর প্রাচীন ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের তাঞ্জোর জেলার ইরেভদ শহরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কুম্ভকোনাম ছিলেন শহরের একটি কাপড়ের দোকানের হিসাব রক্ষক। তাঁর মা ইরোদ জজ কোটের একজন কর্মচারীর কন্যা ছিলেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন মহিলা। প্রচলিত আছে যে, রামানুজনের মায়ের বিয়ের পর বেশ কয়েকবছর কোন সন্তান না হওয়ায়, রামানুজনের মাতামহ নামাক্কল শহরের বিখ্যাত নামগিরি দেবীর নিকট নিজ কন্যা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন। এরপরই জ্যেষ্ঠ সন্তান রামানুজন জন্মগ্রহণ করেন।
পাঁচ বছর বয়সে রামানুজনকে পাড়ার পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। সাত বছর বয়সে তাকে কুম্ভকোনাম শহরের টাউন হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। রামানুজন সাধারণত কম কথা বলতেন এবং মনে হতো তিনি কিছুটা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা স্কুল কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বিভিন্ন গাণিতিক উপপাদ্য, গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি π ও এর মান যে কোন সংখ্যক দশমিক স্থান পর্যন্ত বলতে পারতেন। প্রথমে নিজের এই অদ্ভূত প্রতিভার বিচার তিনি নিজেই করতে পারেননি। তাঁর এক বন্ধু তাঁকে জি. এস. কার (G S Carr)-এর লেখা সিনপসিস অফ পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেম্যাটিক্‌স (Synopsis of Pure and Applied Mathematics) বইটি পড়তে দেন। মূলত এই বইটি পড়েই তাঁর গাণিতিক প্রতিভার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। রামানুজন এই বইয়ে প্রদত্ত বিভিন্ন গাণিতিক সূত্রগুলির সত্যতা পরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর কাছে এগুলো ছিল মৌলিক গবেষণার মত, কারণ তাঁর কাছে অন্য কোন সহায়ক গ্রন্থ ছিল না।
তিনি ম্যাজিক স্কোয়ার গঠনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এরপর তিনি জ্যামিতিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর কাজ শুরু করেন। বৃত্তের বর্গসম্পর্কীয় তাঁর গবেষণা পৃথিবীর বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে নির্ণীত বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য এবং প্রকৃত মানের পার্থক্য মাত্র কয়েক ফুট ছিল। জ্যামিতির সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে তিনি বীজগণিতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। শোনা যায়, রামানুজন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাঁর নোট বুকে কিছু লিখতেন। কী লিখছেন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন যে, নামাক্কলের দেবী স্বপ্নে তাঁকে এই সব সূত্র দিয়ে প্রেরণা দিচ্ছেন। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত এ সকল সূত্র তিনি পরীক্ষণ করতেন, যদিও তাঁর পরীক্ষা পদ্ধতি খুব আনুষ্ঠানিক ছিলনা।
১৬ বছর বয়সে রামানুজন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন ও জুনিয়র শুভ্রামানায়াম বৃত্তি লাভ করে কুম্ভকোনাম সরকারী কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গণিতের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলে পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে অকৃতকার্য হন এবং তাঁর বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি কুম্ভকোনাম ত্যাগ করে প্রথমে বিশাখাপট্টম এবং পরে মাদ্রাজ যান। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ফার্স্ট এক্সামিনেশন ইন আর্টস (F.A. বা I.A) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং অকৃতকার্য হন। তিনি আর এই পরীক্ষা দেননি। এরপর কয়েক বছর তিনি নিজের মত গণিত বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে যান।
১৯০৯ সালে রামানুজন বিবাহ করেন। কিন্তু তাঁর কোন স্থায়ী কর্মসংস্থান ছিলনা। প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি স্বভাবের বিপরীতে জীবিকা অন্বেষণের চেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন একটি পরিচয়পত্র দিয়ে চাকুরীর সুপারিশ করে তাঁকে মাদ্রাজ শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে নিলোর শহরের কালেক্টর দেওয়ান বাহাদুর রামচন্দ্র রাও-এর কাছে প্রেরণ করেন।
রামচন্দ্র রাও কিছুদিনের জন্য রামানুজনের সকল ব্যয়ভার বহন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জন্য কোন বৃত্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় এবং রামানুজন দীর্ঘকাল অপরের গলগ্রহ হয়ে থাকতে সম্মত না হওয়ায় তিনি মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে একটি সামান্য পদের চাকুরীতে যোগদান করেন। কিন্তু তাঁর গবেষণা কর্ম এসবের জন্য কখনো ব্যহত হয়নি।


পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করার সময় কিছু লোকের সাথে তাঁর পরিচয় হয় যারা তাঁর নোটবুক নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেন। এর সূত্র ধরে গণিত বিষয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। ১৯১১ সালে তাঁর প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ Journal of the Mathematical Society পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সংখ্যাতত্ত্বের উপর তাঁর গবেষণালদ্ধ Some Properties of Bernoulli's Numbers নামে তাঁর প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ একই বছর প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে একই পত্রিকায় তাঁর আরো দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং সমাধানের জন্য কিছু প্রশ্নও প্রকাশিত হয়।

রামচন্দ্র রাও মাদ্রাজ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের মি. গ্রিফিথ-কে রামানুজনের ব্যাপারে বলেন। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর সঙ্গে মি. গ্রিফিথ এর আলাপ হওয়ার পর থেকেই রামানুজনের প্রতিভার স্বীকৃতি শুরু হয়। মাদ্রাজ শহরের বিশিষ্ট পন্ডিত শেশা আইয়ার এবং অন্যান্যদের পরামর্শে কেমব্রিজের ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলো জি.এইচ. হার্ডির সঙ্গে রামানুজন যোগাযোগ শুরু করেন এবং তাঁর বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজী ভাষায় একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের সঙ্গে ১২০ টি উপপাদ্য সংযোজিত ছিল, তার ভিতর থেকে নমুনাস্বরূপ হার্ডি ১৫টি নির্বাচন করেন। হার্ডি মন্তব্য করেন
একজন সাধারণ পেশাদার গণিত বিশারদ হিসেবে একজন অপরিচিত হিন্দু কেরানির নিকট হতে পত্রপ্রাপ্তির পর আমার প্রতিক্রিয়া দিয়েই আপনার প্রতি আমার বক্তব্য শুরু করতে চাই।
এরপর হার্ডি ঐ ১২০ টির মধ্যে কয়েকটি ইতিপূর্বে অন্য কোন গণিত বিশারদ প্রমাণ করেছেন বলে উল্লেখ করেন।

“ তবে এগুলি দেখলেই বোঝা যায় যে কেবলমাত্র একজন তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন গণিতবিদের পক্ষেই এগুলো লেখা সম্ভব। এগুলো সবই সঠিক, কারণ সঠিক না হলে এগুলো আবিষ্কার মত ইচ্ছা কারুরই হত না। সবশেষে লেখক নিশ্চয়ই সৎ, কারণ খ্যাতনামা গণিতবিদ চোর বা হামবাগ অপেক্ষা অনেক সাধারণ মানুষ হয়।”
“ রামানুজনের যেমন অনেক গৌরবান্বিত সাফল্য ছিল, তেমনি মৌলিক সংখ্যাভিত্তিক তত্ত্ব ও আনুষঙ্গিক সমস্যায় ভুলও ছিল। এটা তার একটি বড় ব্যর্থতা বলে মনে করা যায়। তবুও আমি নিশ্চিত নই, কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতা তাঁর সাফল্য অপেক্ষা বিস্ময়কর বলে মনে হয়।”
একটি গাণিতিক পদের জন্য ব্যবহৃত প্রতীক (notation) ১৯০৮ সালে এডমুন্ড ল্যান্ডাউ প্রথম উদ্ভাবন করেন। ল্যান্ডাউয়ের মত এত কিছু রামানুজনের ছিলনা। তিনি ফরাসী বা জার্মান ভাষায় কোন পুস্তক কখনো দেখেন নি, এমন কি ইংরেজী ভাষায় তাঁর জ্ঞান এত দুর্বল ছিল যে কোন ডিগ্রীর জন্য কোন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তিনি এমন কিছু বিষয় ও সমস্যার উপস্থাপনা করেছেন যা ইউরোপের অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানীরা ১০০ বছর ধরে সমাধান করেছেন- এমন কি কিছু এখনো সমাধান হয়নি।
অনেকদিন যাবৎ হার্ডি রামানুজনকে কেমব্রিজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। রামানুজনের অনেক বন্ধু ও হিতৈষীর চেষ্টায় ১৯১৩ সালের মে মাসে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের কেরাণীর দায়িত্ব থেকে তাকে অবমুক্ত করা হয় এবং একটি বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। ঠিক এমনি সময়ে তিনি কেমব্রীজ থেকে তিনি একটি আমন্ত্রণ পান। চাকুরীগত সমস্যার সমাধান হলেও জাতিপ্রথা ও মায়ের অনুমতির অভাবে প্রথমে রামানুজন দেশের বাইরে যেতে অসম্মতি জানান।
তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তিনি যথেষ্ট কঠোরতা অবলম্বন করতেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর সব ধর্মই কমবেশি সত্য। তিনি নিরামিষভোজী ছিলেন। তিনি যতদিন কেমব্রিজ ছিলেন, সবসময় স্বপাক আহার করতেন এবং বাইরের পোষাক পাক করতেন।
১৯১৭ সালের বসন্তকালের প্রথমে রামানুজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কেমব্রিজের একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন নি। তাঁকে ওয়েলস, ম্যালটক এবং লন্ডন শহরের স্বাস্থ্য নিবাসে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর তাঁর শারীরিক কোন উন্নতি দেখা যায়নি। এই সময় রামানুজন রয়েল সোসাইটি-র সদস্য নির্বাচিত হন। গবেষণা কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়ার ফলে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান উপপাদ্যগুলো এই সময় আবিষ্কৃত হয়। তিনি নির্বাচিত ত্রিনিত্রি ফেলো ছিলেন। ১৯১৯ সালে রামানুজন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। কিছুকাল যক্ষারোগে ভোগার পর ১৯২০ সালের ১৬ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
Source: Wikipedia, Somokal

0 comments:

Post a Comment