Breaking News
Loading...
Sunday, January 17, 2010


মার্গসঙ্গীতের জাদুকর আলি আকবর খান পিতা উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কাছে তাঁর তালিম শুরু হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে৷ জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে, জন্মতারিখ ১৪ এপ্রিল, ১৯২২৷ পিতা আলাউদ্দিন খাঁয়েরও ছিল ভারতজোড়া খ্যাতি৷ স্বাধীন ভারতে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন আলাউদ্দিন খাঁ৷ উত্তর ভারতীয় মার্গসঙ্গীতে পথপ্রদর্শকদের একজন ছিলেন খাঁসাহেব৷ পিতার কাছে কন্ঠের তালিমের সঙ্গে সঙ্গেই শিশু আলি আকবর তালযন্ত্রের তালিম নিয়েছেন চাচা ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে৷ দিনে আঠারো ঘন্টা কঠোর রেওয়াজ করতে হত৷ পিতা আলাউদ্দিন খাঁ তাঁকে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রও শিখিয়েছেন, কিন্তু একটু বড়ো হওয়ার পর নিজেই বলে দিয়েছেন পুত্রের পথ৷ সরোদ এবং কন্ঠসঙ্গীত৷ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের এই শান্তি আর আনন্দের পথই নির্দিষ্ট করা ছিল আলি আকবরের জন্য৷ ১৯৭২ সালে শতোর্দ্ধ বয়সে পিতার মৃত্যু পর্যন্ত তালিম পেয়েছেন পিতার কাছেই, নিয়মিত৷ পাশাপাশি একের পর এক মেহফিলে বাজিয়ে চলেছেন তরুণ আলি আকবর৷ প্রথম প্রকাশ্য অধিবেশনে তিনি যখন পিতার পাশে বসে বাজান, তখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো৷ ভবিষ্যতের গুণী শিল্পীকে সেদিনেই চিনে নিয়েছিলেন সঙ্গীতানুরাগীরা এক লহমায়৷
ভারতের রামপুর আর মাইহার ঘরাণার শিল্পী ছিলেন আলি আকবর৷ তানসেনের বংশধর বলে এই ঘরাণাকে সেনি ঘরাণাও বলা হয়৷ ইহুদি মেনুইনের অনুরোধে ১৯৫৫ সালে প্রথমবার আমেরিকায় বাজাতে যান আলি আকবর৷ নিউ ইয়র্কের ম্যুজিয়ম অব মর্ডার্ন আর্টে এক সঙ্গীত সম্মেলনে তাঁর সেদিনের বাজনা মুগ্ধ করে দেয় পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের৷ মার্কিন টেলিভিশনে প্রথম ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠানও করেন তিনি৷ পাশ্চাত্য জনমানসে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের জাদুবৃক্ষের বীজ বপনে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গেই আলি আকবরের ভূমিকাও ছিল যথেষ্ট৷ ষাটের দশকে বিশ্বের অন্যত্রও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতীয় সঙ্গীত৷ যে যাত্রাপথের প্রথম পথিক অবশ্যই আলি আকবর খান৷
১৯৫৬ সালে কলকাতাতে আলি আকবর কলেজ অব মিউজিকের সূত্রপাত খানসাহেবের হাতে৷ পরে সেই বিদ্যালয়ের শাখা ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকাতেও৷ ক্যালিফোর্নিয়ার মারিন কাউন্টিতে এই কলেজের শাখা স্থাপিত হয় ১৯৬৭ সালে৷ সমগ্র পাশ্চাত্ত্য বিশ্বের বহু তরুণ তরুণী এই শিল্পীর মধ্য দিয়েই সন্ধান পেয়েছেন ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের অনন্যসাধারণ রূপরসময় জগতের৷
আদ্যন্ত শিল্পী আলি আকবরের বাজনা শোনাও ছিল এক অভিজ্ঞতা৷ সরোদের যা সবচেয়ে কঠিন দিক, সেই জুড়িতার আর চিকারির অনবদ্য লাবণ্যে ভরা থাকত তাঁর বাজনা৷ গভীর মীড়ের ছোঁয়ায় সরোদের পুরুষালী দাপটও তাঁর বাজনার এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য ছিল বৈকি৷ সরোদ এমন এক যন্ত্র, যাতে সেতার, এস্রাজ, জলতরঙ্গ বা অন্যান্য তারযন্ত্রের মত ঘাট থাকে না৷ সরোদ বাজাতে হয় হাতের টিপ দিয়ে৷ আলি আকবর খানের বাদনশৈলীতে সেই টিপ বা সরগমের ঘনত্ব ছিল অনুভাবী আর মাধুর্যময়৷ স্বকৃত গুণে সরোদবাদনের মধ্যে তিনি যে আশ্চর্য প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, সঙ্গীত রসবেত্তার কাছে সেই শ্রবণ অনুভূতি ছিল যেন ভিন্ন মাত্রার, ছিল স্বর্গীয়৷
অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন আলি আকবর৷ ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ পেয়েছেন তিনি৷ পেয়েছেন লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী কালচারাল অ্যাওয়ার্ড, বিল গ্রাহাম লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, ১৯৯৫ সালে এসিয়ান পেইন্টস-এর সম্মানজনক শিরোমণি অ্যাওয়ার্ড৷ ১৯৯৬ থেকে ৯৮ পরপর তিন বছর তাঁর সঙ্গীত গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে৷ এসবের বাইরে স্বদেশ আর বিদেশে অসংখ্য ছোটবড় সম্মান আর পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন শিল্পী আলি আকবর খান৷
সঙ্গীত, বিশেষত ভারতীয় মার্গসঙ্গীত প্রসঙ্গে একটি বড় প্রিয় বাক্যবন্ধ ছিল শিল্পী আলি আকবর খানের৷ বলতেন, আশৈশব জানি, সঙ্গীত আমাদের কাছে, আমার পরিবারের কাছে জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় আহরণ৷ এ আসলে আমাদের খাদ্য৷ যাকে বাদ দিয়ে জীবনধারণ অসম্ভব৷ যখন সেই খাদ্যের প্রয়োজন তোমার হবে, সেই মুহূর্তে তুমিও বুঝবে, এ তোমার হৃদয়ের কতখানি৷
হৃদয়ের সবখানি দিয়েই আজীবন সঙ্গীত সৃষ্টি করে শিল্পের গন্ধর্বলোকে চলে গেলেন আলি আকবর খান৷ ২০০৯ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর বাসভবনে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮৷

0 comments:

Post a Comment