দশ বছর বয়সে যাত্রাদলে যোগ দিতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে বাংলা লোক ঐতিহ্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে গায়ক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও নুলো গোপালের শিষ্য হোন। আলাউদ্দীন খান দীর্ঘ বার বছর সংগীতের উপর সাধনা করেন। এই সাধনার সপ্তম বর্ষে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরু নুলো গোপাল মৃত্যু বরণ করলে তিনি অমৃতলাল দত্তের শিষ্য হোন- যিনি স্বামী বিবেকানন্দের নিকটাত্মীয় ছিলেন এবং কলকাতার স্টার থিয়েটারে সংগীত পরিচালক ছিলেন। আলাউদ্দীন খান বাদ্যযন্ত্রী হবার অভিপ্রায়েই সেখানে গিয়েছিলেন। এই সময়ে গোয়া থেকে আগত ব্যান্ডমাস্টার লোবো’র কাছে ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল বায়োলিনের উপর শিক্ষা নেন।
আলাউদ্দীন খান মুক্তাগাছার জমিদার জগত কৃষ্ণ আচার্যের নিকেতনে সংগীত পরিবেশন শুনে সারোদের প্রতি আকৃষ্ট হোন। তিনি আহমেদ আলী খানের সারোদ পরিবেশনা শুনেন। তিনি তাঁর শিষ্য হয়ে যান এবং গুরুর অনুগত থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর সাধনা করেন। আলাউদ্দীন খান পরবর্তীতে রামপুরের(উত্তর প্রদেশ, ভারত) ওয়াজির খান বীনকরের কাছে যান শিক্ষা নিতে। ওয়াজির খান ছিলেন সেখানকার নবাবের জলসাঘরের কলাকার এবং তিনি তানসেনের বংশের শেষ উত্তরাধিকারী। তিনি আলাউদ্দীন খানকে মিঞা তান সেনের সেনিয়া ঘরানার সংগীতে শিক্ষা দেন। এরপরে মইহারের জমিদার ব্রজনাথ সিং এর জলসাঘরের কলাকার হোন আলাউদ্দীন খান।
কলাকার হিসেবে থাকাকালীন সময়ে তিনি সংগীতের মইহার ঘরানাকে নতুন করে সাজান। মইহার ঘরানা ঊনিশ শতকে সৃষ্টি হয়। কিন্তু আলাউদ্দীন খানের কাজ এতই মৌলিক ভিত্তির ছিল যে- তাঁকে এই ঘরানার স্রষ্টা বলা হয়। এই সময়ে তাঁরই হাত ধরে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতে((উত্তর ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ- এর সংগীত) পরিবর্তন আসে।
সারোদে কলা প্রদর্শন করলেও আলাউদ্দীন খান অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন। মইহার(বর্তমান নাম) নামে একটি স্ট্রিং ব্যাণ্ড গঠিত হয়।তাঁর পুত্র আলী আকবর খানকে তিনি সারোদে শিক্ষা দেন। তাঁর মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী সুরবাহার বাজানোর শিক্ষা নেন। রবি শঙ্কর এবং নিকিল ব্যানার্জি সিতার বাজাতেন। রবিন ঘোষ বেহালা বাজাতেন এবং পান্নালাল ঘোষ বাঁশী বাজাতেন। বসন্ত রায় ছিলেন আলাউদ্দীন খানের শেষ শিষ্য। শিষ্য হিসেবে পণ্ডিত রবি শঙ্কর এবং আলী আকবর খান মইহার ঘরানাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন (এঁরাই বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় কনসার্ট করেছিলেন।) যা আলাউদ্দীন খান ১৯৩৫-১৯৩৬ সালে উদয় শঙ্করের নৃত্যদলের সাথে আন্তর্জাতিক ভ্রমনের সময় শুরু করেছিলেন ।
আলাউদ্দীন খান একজন ধার্মিক লোক ছিলেন। নামে মুসলমান হলেও তিনি দেবী সরস্বতীর ভক্ত ছিলেন (মিঞা তানসেনের মত)। সারদা দেবীর প্রতীমায় তিনি সরস্বতীর সাধনা করতেন, মইহারের পাহাড়ের চূড়ায় একটি মন্দির ছিল। এই কারণে আলাউদ্দীন খান বিভিন্ন জলসাঘর থেকে লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও মইহার ছেড়ে যাননি; এমনকি চিকিতসার জন্য হাসপাতালেও যেতে চাইতেন না সেই জায়গা ছেড়ে। তিনি মৃত্যুকেই বরণীয় মনে করতেন এই জায়গা ছেড়ে যাবার চেয়ে।
আলাউদ্দীন খান মদনমঞ্জরী দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলে আলী আকবর খান সারোদ বাদক। তিন মেয়ে ছিলেন- শারিজা, জেহানারা, রোশনারা(অন্নপূর্ণা দেবী, রবি শঙ্করের সহধর্মিনী)।
আলাউদ্দীন খান বিভিন্ন রাগ সৃষ্টি করেন। তিনি সংকীর্ণ রাগের উপর কাজ করতে পছন্দ করতেন। তাঁর সৃষ্ট রাগ হচ্ছে- অর্জুন, ভগবতী, ভীম, ভুবনেশ্বরী, চণ্ডিকা, ধবলশ্রী, ধনকোষ, দীপিকা, দুর্গেশ্বরী, গান্ধী, গান্ধী বিলওয়াল, হৈমন্তী, হেম-বিহাগ, হেমন্ত ভৈরব, ইমনি মঞ্ঝ, জানুপুরী তোড়ি, কেদার মঞ্ঝ, কোমল মারওয়া, মদনমঞ্জরী, মাধবশ্রী, মাধবগিরি, মালয়া, মঞ্ঝ খামাজ, মেঘবাহার, মুহাম্মদ, নাত-খামাজ, প্রভাকলি, রাজ বিজয়, রাজেশ্রী, শোভাবতী, সুগন্ধা এবং সুরসতী।
ভারতীয় সংগীতের উপর অবদানের জন্য তিনি সংগীত নাটক একাডেমীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ এবং আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন- সংগীত নাটক একাডেমী ফেলোশিপ(১৯৫২)। ১৯৫৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ উপাধি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মবিভূষণ উপাধি পান।ছয় সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সালে এই মহান কলাকার তাঁর দীর্ঘ সংগীত জীবনের অবসান ঘটিয়ে একানব্বই বছর বয়সে ওপারে পাড়ি দেন।
সূত্রঃ জ্ঞানকোষ
0 comments:
Post a Comment