৩০ মার্চ ১৮৫৩ সালে বেলজিয়ান সীমান্তবর্তী ছোট এক ডাচ গ্রামে গ্রোট জুনডার্টে ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গগের জন্ম। ভ্যান গগের জন্মের এক বছর আগে থেকেই তার পরিবারে বিষাদঘন পরিবেশ বিরাজ করছিলো। পার্দ্রী থিওডর ভ্যান গগ ও তার ¯ত্রী কর্ণেলিয়ার প্রথম সন্তান মৃত হয়েই জন্মায়। এই দুঃখজনক ঘটনার ঠিক এক বছর পর একই দিনে জন্ম নেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। কিন্তু ভিনসেন্টের জন্মতেও তারা পূর্বের মৃত সন্তানের স্মৃতি ভুলতে পারেননি। তাই মৃত ছেলের নামেই ভিনসেন্টের নামকরণ করা হয়। জন্মেই ভিনসেন্ট উপহার পেলেন তার মৃত ভায়ের নাম। শুধু নামই নয়, ভিনসেন্ট ভ্যান গগের পুরো শৈশবটাই কাটে মৃত ভায়ের স্মৃতি নিয়ে। বাড়ির কাছেই মৃত ভায়ের কবর ছিলো। ছোট্ট ভ্যান গগ তারই নামের মৃত বড় ভায়ের কবর দেখে দেখে বড় হন।
পরবর্তীতে ভ্যান গগ পরিবারে আরও শিশু আসে। কিন্তু ছোট ভাই থিও এবং তিন বোনের সঙ্গে ভ্যান গগ খেলাধূলায় খুব কমই অংশ নিতেন। ছোট্ট বেলা থেকেই তিনি একটু অন্য ধরণের ছিলেন। গাঁয়ের নির্জন মাঠে-ঘাটে একা একা ঘুরে বেড়াতেন তিনি। তার স্কুল জীবনের কথা তেমন কিছু জানা যায় না। হয়তো তেমন কোন বন্ধু-বান্ধবও তার ছিলো না। ১২-১৩ বছর বয়সে তিনি প্রথম আঁকতে শুরু করেন। এই সময়টা মূলত পেন্সিলে ড্রইং করতেন আপন খেয়ালে। তার এক চাচা হেগের আর্ট ডিলার ছিলেন। প্যারিসের বিখ্যাত চিত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গোপিল এণ্ড কো.-এর সঙ্গে ব্যবসা করতেন ভিনসেন্টের চাচা। ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পাঠ শেষ করেই চাচার অফিসেই ভিনসেন্টের চাকরী হয়। টানা চার বছর চাকরী করেন তিনি, মাঝখানে কিছুদিন ব্রাসেলসের শাখাতেও কাজ করেন তিনি। এরপর ১৮৭৪ সালে লন্ডনে বদলী হয়ে আসেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
লন্ডনের বাড়িতে থাকাকালেই বাড়িঅলার মেয়ের প্রেমে পড়েন ভ্যান গগ। সে প্রেমের তীব্র টানে ক্রমাগত কাজে ফাঁকি পরতে থাকে তার। ফলাফল হিসাবে তার চাকরীটা চলে যায়, প্রেম জাগিয়ে রাখারও কোন উপায় থাকে না। বাধ্য হয়ে ব্যর্থ হতাশ প্রেমিক ভ্যান গগকে স্বদেশে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু দেশে ফিরলেও ইংল্যান্ডের মায়া তার হয়তো কাটে না। ১৮৭৬ সালে রামসগেটের একটি স্কুলের অবৈতনিক সহকারী পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন তিনি। কয়েকমাস পরই স্কুলটি লন্ডনে স্থানান্তরিু হয় এবং তার দায়িত্ব পরে শহরের দরিদ্রতম এলাকার ছাত্রদের কাছ থেকে বকেয়া আদায় করার। বকেয়া আদায় করতে গিয়ে তিনি লন্ডন শহরের হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবন খুব কাছ থেকে দেখেন। বকেয়া আদায় তো দূরের কথা পারলে তিনি এদের সাহায্য করে আসতেন। কোন বকেয়া আদায় করতে না-পারায় যথাবিহিত এবারও চাকুরীচুত্য হন তিনি।
কিন্তু দারিদ্র্যের এ চেহারা তার মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রবল করে তোলে। পিতার পদা অনুসরণ করে সহকারী পার্দ্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেই উদ্দেশ্যেই লন্ডন ছেড়ে রওনা হলেন হলান্ডে। বাবা-মা ভিনসেন্টের এ সিদ্ধান্তে দারূণ খুশি হলেন। কিন্ত তাদের মধ্যে সন্দেহ ছিলো, পার্দ্রী হওয়ার জন্য যে পরিমাণ পড়াশুনা করা দরকার তা ভিনসে করবেন কি-না। তাদের সন্দেহ যথার্থ প্রমাণিত হলো। এক বছরের মাথায় ভিনসেন্ট আর পড়াশুনা করলেন না। তবে মানব সেবার ইচছাটা তার মনের মধ্যে রয়েই গেলো। ২৫ বছর বয়সে বেলজিয়ামেন বোর্নিয়াজের এক কয়লা খনিতে পার্দ্রী হিসেবে যোগ দিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
এ কয়লা খনিতে তিনি লন্ডনের চেয়ে বিভৎস দারিদ্র্য দেখলেন। খ্রীস্টে ‘এরাব ঃড় ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ’ - বাণীকে তিনি নিজের জীবনের ব্রত করে নিলেন। এই গরীব-দুঃখী খনি শ্রমিকদের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন তিনি। কখনো গায়ের কাপড় খুলে দিতেন কোন শ্রমিককে, কখনো নিজের খাবার দিয়ে দিতেন তাদেরকে। নিজের কাপড়-চোপড় বিলিয়ে দিয়ে তিনি নিজেও এই গরীব শ্রমিকদের শ্রেণীতে নেমে এলেন। সম্ভবত, ভিনসেন্টের এতো আবেগ কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলো না। ‘ভিনসেন্টের পোশাক-আশাক চাল-চলন পবিত্র পথের উপযোগী নয়’ - কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগের ভিত্তিতে চাকরী হারালেন তিনি।
চাকরী হারালেও বোর্নিয়াজ ত্যাগ করলেন না তিনি। এখানকার মাটি কামড়ে, শ্রমিকদের সঙ্গী হয়ে দু’বছর ছিলেন ভ্যান গগ। কেউ জানে না, চাকরী ছাড়া কী অবর্ণনীয় কষ্টে কেটেছে তার! কিন্তু ইতিহাস জানে, এই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন, শিল্পী হওয়ার। খনি শ্রমিকদের ছবি আঁকলেন ভ্যান গগ।
দু’বছর পর স্বদেশে ফিরলেন তিনি। বাবা-মা’র সঙ্গে দিন কাটাতে লাগলেন তিনি আর আঁকতে থাকলেন অসংখ্য ছবি। তার ৩৭ বছরের জীবনে এই স্বল্পতম-সময়টুকুই কেবল সুখে কাটিয়ে ছিলেন পৃথিবীর দুঃখীতম শিল্পী ভ্যান গগ। এখানেই আবার প্রেমে পড়লেন তিনি এবং যথাবিহিত প্রেমে ব্যর্থ হলেন। আবার তার মানসিক অস্থিরুা বাড়তে থাকে। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন বাবার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে প্রচণ্ড তর্ক বেঁধে যায় ভ্যান গগের। এই ঝগড়ার জের ধরেই ১৮৮১ সালের ক্রিসমাসের দিন বাড়ি ছেড়ে হাগের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি।
না, তার কাছে কোন টাকাই ছিলো না তখন। ছোট ভাই থিও-এর কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখলেন তিনি। এখানে বলে রাখা দরকার, ভ্যান গগ তার সারা জীবনে কারও কাছেই কোন সাহায্য, সহানুভূতি পাননি, এক ভাই থিও ছাড়া। ভ্যান গগের শিল্পী জীবন ঘিরে ছায়ার মতো জড়িয়ে আছে এই ভায়ের সাহায্য-সহানুভূতি। ছোট্ট চাকরী করতেন থিও। কিন্তু তার সীমিত আয় থেকেই টাকা বাঁচিয়ে ভাইয়ের জন্য পাঠাতে লাগলেন তিনি। হাগের ভূ-দৃশ্য [ষধহফংপধঢ়ব] শিল্পী মভঁ তাকে আঁকায় উৎসাহ দেন। যথাবিহিত তীব্র কলহের মাধ্যমে ভিনসেন্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। এ সময় এক পতিতার সঙ্গে ঘর ভাড়া করে থাকেন তিনি। শুধু তাই নয়, সেই পতিতার সঙ্গে তার প্রেম এমন পর্যায়ে যায় যে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ভাই থিও-এর আপত্তির কারণে এ বিয়ে তার করা হয়নি।
১৮৮৪ সালে আবার দেশে ফেরেন ভ্যান গগ। বাবা-মা তাকে এমনভাবে গ্রহণ করেন যেন তাদের ‘হারানো ছেলে ফিরে এসেছে।’ স্বদেশের কৃষকদের ছবি আঁকতে থাকেন তিনি। এ পর্বে তিনি আঁকেন বিখ্যাত আলু খাদকেরা [ঞযব চড়ঃধঃড় ঊধঃবৎং] ছবিটি। একটি কৃষক পরিবার সন্ধ্যায় আলু দিয়ে তাদের রাতের খাবার সারছে - এই হলো তার ছবির বিষয় বস্তু।
ভ্যান গগ বাড়ি ফেরার এক বছরের মাথায় বাবা থিওডর মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তিনি আবার স্বদেশ ত্যাগ করেন। এই তার শেষ দেশ ত্যাগ করা, কেননা, এরপর আর কখনোই তিনি মাতৃভূমির মুখ দেখেননি।
দেশ ছেড়ে তিনি প্রথম আসেন বেলজিয়ামে। এখানে তিনি এন্টর্প একাডেমিতে ভর্তি হন। তার ইচছা ছিলো, পদ্ধতিগতভাবে ছবি আঁকার নিয়ম-কানুনগুলো শিখে নেয়ার। কিন্তু নিয়মের নিগঢ়ে বেঁধে থাকার মতো শিল্পী তিনি ছিলেন না। ফলে ফার্স্ট টার্ম শেষ হওয়ার আগেই আর্ট একাডেমি ছাড়লেন ভ্যান গগ। এদিকে যখন তার ফলাফল বের হয় তখন তিনি প্যারিসে ঠিকানা গেড়েছেন। প্যারিসে এসে ভাই থিও-এর মোল্টমার্টের ছোট্ট ফ্লাটে ঠাঁই নিলেন তিনি। বলা দরকার, প্যারিসের উত্তরে পাহাড়ের উপরের এই অঞ্চল ছিলো বিশ্ব চিত্রকলার অন্যতম কেন্দ্রভূমি।
চিত্রকলার প্রথাগত শিক্ষা কখনোই পাননি ভ্যান গগ। বেলজিয়াম থেকে প্যারিসে এসে সে চেষ্টাটা আবার করলেন তিনি। এবার কোন একাডেমিতে নয়, ফানার্ড করমনের স্টুডিওতে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ফানার্ড করমনের এ স্টুডিও সে সময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ভ্যান গগের সঙ্গে এ স্টুডিওতে কাজ করতেন পরবর্তীকালের বিশ্ব বিখ্যাত অপর দুই শিল্পী তুলজ লোত্রেক এবং এমিলি বানার্ড। কয়েকমাস কাজ করার পর তারা তিনজনই এ স্টুডিও ছেড়ে দেন। করমন এ সময় মঁনের নেতৃত্বে রেঁনোয়া ও দেগার সঙ্গে প্রকাশবাদীদের দলে যোগ দেন। ভিনসেন্ট প্রকাশবাদীদের দলে নাম না-লেখালেও তাদের রঙের ব্যভহার ও খোলা প্রকৃতিতে কাজ করার ধারায় প্রভাবিত হন। ইতোমধ্যে ভাই থিও-এর মাধ্যমে আরেক প্রকাশবাদী ক্যামিলো পিসারো এবং বিপ্লবী চিত্রকর পল গঁগ্যার সঙ্গে তার পরিচয় হয় পরবর্তীতে এই গঁগ্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং বিচেছদ ব্যাপক আলোচিত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য ভিনসেন্টের শিল্পকলার গুণ যতোই বাড়ছিাে প্যারিসের অন্য শিল্পীদের কাছে তেেতাই তিনি সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠছিলেন। বিষন্ন, বিরক্ত ভ্যান গগ ভীষণ মদ্য পান করতে লাগলেন, তার মেজাজ আরও তিরীক্ষ হয়ে উঠলো। সরল এ শিল্পী কখনোই তার মতকে আড়াল করতে পারতেন না, বা মৃদুভাবে কোন বক্তব্য প্রকাশও করতে পারতেন না। একটুতেই উত্তেজিত হয়ে যেতেন তিনি। এমনকি ভাই থিও-এর সঙ্গে একবার ঝগড়া হয়ে গেলো। দুই বছর প্যারিসে থেকে বিরক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দও রিষষ ঃধশব সুংবষভ ড়ভভ ংড়সবযিবৎব ফড়হি ংড়ঁঃযদ তার মনে হয়েছিলো ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল জাপানের মতো হবে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ভ্যান গগ এ সময় জাপানের চিত্রকলা ও জীবনাচরণের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়ে ছিলেন। সে সময় প্যারিসে শস্তায জাপানী প্রিন্ট পাওয়া যেতো। এ সব প্রিন্ট দেখে তার কাছে জাপান স্বপ্নে দেশ মনে হয়ে ছিলো। অতএব ১৮৮৮ সালের ফেব্রয়ারি মাসে ট্রেনে করে তিনি দক্ষিণ ফ্র্রান্সের মার্সেল প্রদেশের নিকটবর্তী শহর আর্লেসে এসে পৌঁছলেন। তার পৌঁছনোর সময় পুরু শহরটা বরফে ঢাকা ছিলো। কিছুদিন পরই এলো বসন্ত। তিনি প্লে লামার্টিনের একটি দোতালা বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো এর বাইরের দেয়ালটি হলুদ রঙের। জাপানে হলুদ মানেই বন্ধুত্বের রঙ। এ বাড়িতে উঠতে পেরে ভ্যান গগের মনেও যেন বসন্তের ছোঁয়া লাগলো। ভীষণ আনন্দিত হলেন তিনি। থিও লিখলেন, ‘ভাবনুগুাে পাখির ঝাঁকের মতো দল বঁধে আমার কাছে আসছে।’
কিন্তু তিনি সুখী হলেওশহরের অধিকাংশ লোক তার অদ্ভুত চালচলনে রিক্ত হলেন। অবশ্য ডাকপিয়ন রঁলি ও তার পরিবার, স্থানীয় ক্যাফের মালিক এবং একজন আর্মি ল্যাফটেনেন্টের সঙ্গে তার দারূণ খাতির হয়ে গেলো। এ সময়টা অমানুষিক পরিশ্রম করতে লাগলেন ভ্যান গগ, কিন্তু তার মধ্যে কোন ক্লান্তির ছাপ ছিলো না। খুশি মনে একের পর এক ছবি আঁকতে লাগলেন তিনি। আর বহুদিনের লালিত এক স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কথা ভাবলেন ভ্যান গগ। তিনি বহুদিন ধরেই ভাবছিলেন, শিল্পীদের একটা নিজস্ব কলোনি হবে, যেখানে শিল্পীরা একসাথে থাকবে, গল্প করবে, ছবি আঁকবে..। মনের মতো হলুদ বাড়ি পেয়ে সে স্বপ্ন পুরণে নজর দিলেন ভ্যান গগ। প্রথমেই তিনি আমšত্রণ জানালেন পল গগ্যাঁকে। তার ধারণা ছিলো, গগ্যাঁ এলে তার দেখাদেখি অন্য শিল্পীরাও আসতে শুরু করবেন। কিন্তু গগ্যাঁ আসতে চাইলেন না। অবশেষে থিও তাকে যাতায়তের খরচ দেবেন বলায় গগ্যাঁ আসতে রাজী হলেন।
১৮৮৮ সালের অক্টোবরে গগ্যাঁ আর্লেসে এলেন। কিন্তু আর্লেসে পা দিয়েই বিরক্ত হলেন গঁগ্যা। আর্লেস তো তার পছন্দ হলোই না, সেইসঙ্গে পছন্দ হলো না ভিনসেন্টের ‘হলুদ বাড়ি’ এবং স্বয়ং ভিনসেন্ট ভ্যান গগকেও। ভ্যান গগও ক্রমশ অপছন্দ করতে লাগলেন গগ্যাঁকে। ভ্যান গগের পছন্দ করা এক পতিতা-মডেলের দিকে নজর পড়লো গঁগ্যা। সেই পতিতাও গঁগ্যাকে প্রশ্রয় দিতে লাগলেন। ক্রমশ ভ্যান গঁগ ও গঁগ্যার বন্ধুত্ব তিক্ততায় পরিণত হলো। ভ্যান গগ তার ধৈর্যের বাঁধ হারিয়ে ফেললেন। ভাই থিওকে চিঠিতে অনুরোধ করলেন, গঁগ্যাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে রাতেই [১৮৮৮ সালে ক্রিসমাসের রাত] ভ্যান গগ একটা মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন গঁগ্যার দিকে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন গঁগ্যা। কিন্তু ভ্যান গগ থামলেন না। ক্ষুর হাতে নিয়ে বন্ধুকে তাড়া করলেন। গঁগ্যা সে রাতে একটা হোটেলে ঠাঁই নিলেন এবং ভ্যান গগকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিলেন। ভ্যান গগ শান্ত হলেন না। হাতের ক্ষুরটি দিয়ে নিজের ডান লতির কানটি কেটে ফেললেন ভ্যান গগ। কাটা কানটি সেই পতিতার কাছে ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন, কারণ সে একবার ভ্যান গগকে উপহাস করে তার কানদুটো সুন্দর বলেছিলো।
এ ঘটনার পর প্রথম যে ট্রেনটি পান সেটিতে চেপেই গঁগ্যা প্যারিসে রওনা হন। এদিকে কাটা কান নিয়ে ভ্যান গগ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রক্তাল্পতা এবং হ্যালুসিনেসনে ভূগতে থাকেন তিনি। আর্লেসের হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে দু’সপ্তাহ চিকিৎসা চলে তার। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফিরেই আবার কাজে মগ্ন হয়ে যান তিনি। দিনরাত অবিরাম ছবি আঁকতে থাকেন তিনি। নাওয়া খাওয়ার বাদ দিয়ে অদ্ভূত উন্মাদের মতো ছবি আঁকতে থাকেন তিনি। অসম্ভব শারীরিক পরিশ্রান্ত এবং মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় আবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এবার দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার জীবনের চরম বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচেছন জেনেই আর্লেসের ৮০ জন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ নগর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদনে জানান - ভ্যান গগের মতো পাগলকে যেন শহর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সাধের ‘হলুদ বাড়িতে’ আর থাকা হলো না ভ্যান গগের। এক বছর আর্লেসে থাকার পর সহনাগরিকদের এই আচরণ তাকে হতাশ করে ফেলে। বন্ধু গঁগ্যা চলে গেছে, আর কোন শিল্পী আসেনি তার আর্লেসের বাড়িতে, গড়ে উঠেনি শিল্পী কলোনী, এখানেও প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি...। চরম হতাশা, অবসাদ আর গ্লানি নিয়ে মে মাসে আর্লেস ত্যাগ করেন ভ্যান গগ। দূর থকে যে শহরকে তার স্বপ্নের শহর মনে হয়েছিলো সে শহর থেকে প্রত্যখাত হয়ে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও মানসিক শান্তি পেলেন না। ফলে আর্লেসের নিকটবর্তী শহর সেন্ট রেমি’র এক মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিজেই গিয়ে ভর্তি হলেন।
ক্রমশ অসুস্থ হয়ে উঠেন ভ্যান গগ। তার জন্মের সময়ই মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি, সেই সঙ্গে ছিলো মৃগী রোগের প্রকোপ এবং সর্বোপরি এই দুই উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয় তীব্র মানসিক অস্থিরুা। সব মিলিয়ে সত্যিকার অর্থেই পূর্ণ পাগল হয়ে যান তিনি। কিন্তু কোন চিকিৎসাই গ্রহণ করতে রাজী হননি তিনি। সপ্তাহে দুইবার গোসল করা - ব্যাস, চিকিৎসকের এইটুকু পরামর্শই গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পাগলামীটাও টানা ছিলো না। তিন মাস পর পর খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠতেন; আবার অসুস্থ হয়ে যেতেন। কিন্তু এতো অসুস্থতার মধ্যেও ছবি আঁকা বন্ধ করেননি তিনি। ভাবতেও অবাক লাগে, মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে বসে ২০০ ক্যানভাস আঁকেন ভ্যান গগ!
এরই মধ্যে তার জীবনের একমাত্র সুসংবাদটি পান তিনি। ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসের এক প্রদর্শনীতে ভ্যান গগের আঁকা ‘আর্লেসের আঙুরক্ষেত’ ছবিটি বিক্রি হয় ৪০০ ফ্রাঁতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তার জীবতকালে এই একটি মাত্র ছবিই বিক্রি হয়েছিলো। তবু ভাই থিও-এর কাছ থেকে এই একটি ছবি বিক্রির সংবাদ পেয়েই আনন্দিত হন ভ্যান গগ।
একটু সুস্থ হয়ে উঠতেই সাধের ‘দক্ষিণাঞ্চল’ ত্যাগ করেন ভ্যান গগ। তার আরেক বন্ধু প্রকাশবাদী শিল্পী ক্যামিলো পিসারো থাকতেন প্যারিসে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভঁরো-তে। ফরাসী শিল্পীদের কাছে এ গ্রাম্য এলাকাটিও খ্যাত ছিলো। প্রথমেই ভ্যান গগ চলে যান প্যারিসে। ভাই থিও-এর ফ্লাটে কিছৃুদিন কাটালেন তিনি। তারপর সোজা চলে গেলেন অঁভরোতে। অভঁরোয় ড. গাঁচের চিকিৎসাধীন থেকে মহা উৎসাহে আতে লাগলেন ভ্যান গগ। স্থানীয় এক ক্যাঁফেতে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে থাকতে লাগলেন তিনি। এরমধ্যে আবার প্যারিস গেলেন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এখানে এসে ভালো লাগলো না তার। ভাই থিও-এর অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না, এদিকে ভ্যান গগের খরচও বাড়ছিলো। চিত্রশিল্পী হওয়ার পর থেকে প্রায় ভাইয়ের খরচে চলেছেন ভ্যান গগ, তার নিজের কোন আয়-রুজি ছিলো না, এদিকে তার খরচ বাড়ছে...। অতএব আবার দুঃশ্চিন্তা ও হতাশার মেঘ গ্রাস করলো তাকে।
বিষন্ন ভ্যান গগ ফিরে এলেন অভঁরো। ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই অভঁরের মেঠোপথ দিয়ে একা একা হেঁটে বেড়ালেন ভ্যান গগ। বিষন্ন, হতাশ শিল্পী সন্ধ্যার মুখেই ঘরে ফিরলেন। রাতের খাওয়া খেলেন না, কাউকে কিছু বললেন না; সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। তারপর... সোজা নিজের বুকে গুলি করলেন তিনি। সারা রাত বুকে গুলি নিয়ে শুয়ে থাকলেন আর ঐ অবস্থাতেও খালি পাইপ টেনে গেলেন। পরদিন সকালবেলা ড. গাচের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন ভাই থিও, এলেন বন্ধু-বান্ধবরাও। রাত নেমে এলে। বিষন্ন, মৃতপ্রায় ভ্যান গগকে ঘিরে বসে রইলেন সবাই। অবশেষে রাত ১টায় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়লেন পৃথিবীর দুঃখীতম শিল্পী ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গগ। তখন তার বয়স মাত্র ৩৭ বছর।
ভ্যান গঘ
Info Post
0 comments:
Post a Comment