ফরায়েজী নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ (রহ.) বাংলাদেশের তথা বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দলনের প্রথম ঘোষক, আধ্যাত্মিক জগতের সূর্য, নির্যাতিত-নিপীড়িত কৃষক-তাঁতীদের নয়নমণি, শিরক-বিদআত ও বৃটিশের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণাকারী ছিলেন। এই বীর পুরুষ একই সাথে ছিলেন অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে অকুতোভয় সৈনিক, ফরায়েজী আন্দেলনের নেতা। বৃটিশ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ঘোষক হাজী শরীয়তুল্লাহ (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ১১৮৬, ইংরেজী ১৭৮১ সালে সামায়েল যা বর্তমানে শিবচর থানাধীন বাহাদুরপুর গ্রামের (তাৎকালীন বাকেরগঞ্জের পরিবর্তে ফরিদপুরের) মাদারীপুর জেলায়। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জলিল তালুকদার, যিনি এলাকার খাজনা আদায়ের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং গরিব জনগণকে দান করার ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিল। আট বছর বয়সে পিতার ইন্তেকাল হলে তাঁর পুত্রহীন চাচা আজিম ও তার স্ত্রীর আশ্রয়ে পড়াশুনা করেন।
হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ (রহ.) লেখাপড়া করেছেন বাংলায় আর মক্কা-মদীনা ও মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আরবী সাহিত্য, হাদীস, আফসীর, ফিকাহ্ ও ইসলামী শিক্ষা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। দেশে ফেরার পর লোকেরা জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার কারণে তাকে ‘কুতুবুল বাঙ্গাল’ উপাধি দেন। তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বাংলায় শিরক, বিদআত ও বৃটিশদের বিরুদ্ধে ইসলামী দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়েছেন। তিনি ছিলেন রাসুল (স.)-এর অনুসারী ও একজন খাঁটি উম্মত। হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ প্রথম ১৩ বছর (১৮১৮-১৮৩১) দাওয়াতি কাজ করেন। আর বাকি ১০ বছর (১৮৩১-১৮৪০) দাওয়াত, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা ও আদালত স্থাপন ও জমিদার নীলকর তথা বৃটিশদের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হন। এটা একজন আল্লাহ্র প্রকৃত ওলীর কারামত। তিনি জনগণকে ইসলামের মূল কর্তব্যসমূহ তথা ফারায়েজ (শরীয়তের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য) শিক্ষাদানে রত থাকেন। এভাবে তিনি যে সংগঠন কায়েম করেন তাঁর নাম “ফারায়েজী আন্দোলন।” যারা এই কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন তাদেরকে ফারায়েজী বলা হয়।
হাজী শরীয়তউল্লাহ্ (রহ.) তাওহীদের বাণী প্রচার করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের পূজা পার্বন থেকে মুসলমানদের বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু হিন্দুদের পূজায় বাধা দেননি। কিছু পুঁথি সাহিত্য ও তাঁর বিরোধী বৃটিশ লেখকদের লেখনি এবং তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁর শিক্ষাগুলো নিম্নরূপ- হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ (রহ.) যে বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা হলো, আল্লাহ্র একত্ব প্রকাশ করা, আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক না করা। তাওহীদের এই বিষয়ের সাথে তিনি কখনো আপোষ করেননি। কোনো মুসলমান তাঁর সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে তাওবা-ইস্তেগফার পড়িয়ে ও শিরকবিদআত থেকে দূরে থাকার এবং অতীত গুনাহ্সমূহ পুনরায় না করার প্রতিজ্ঞা করাতেন। কুরআনকে অক্ষরে অক্ষরে ও রাসূল (স:)-এর সুন্নত পালন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন।
ইসলামের সে সমস্ত ফরজ রয়েছে যেমন- মুখে কালিমা বলা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম করা, রমজান মাসের রোজা রাখা, যাকাত দেয়া, হজ্ব করা এবং অন্যান্য ফরজ পালন করা প্রতিটি ফারায়েজী ভাই-এর জন্য আবশ্যক। ‘লাঙ্গল যার জমিন তার’ এই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলার নির্যাতিত কৃষকদেরকে তিনি এক ময়দানে শামিল করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “এই জমিন আল্লাহ্র। সুতরাং খাজনা দিব আল্লাহ্কে। বৃটিশ অথবা তাদের সহযোগী হিন্দু জমিদারকে কোনো খাজনা দেয়া যাবে না।” তাছাড়া তিনি সরকারী খাস মহলগুলো দখলে এনে গরীব কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতেন। খোয়াজ খিজিরের নামে কলা গাছের ভেলা ভাসানো, বিবি ফাতেমার পূজা, দশেরা ও রথযাত্রা, চড়ক পূজা, হাসান-হোসাইন উপলক্ষে রক্তঝরানো, বুক চাপড়ানো ও হিন্দু ধাত্রীসহ অনেক কিছু তিনি নিষিদ্ধ করেন। তিনি আব্দুল কাদের জিলানী (রা.)-এর তাসাউফের অনুসারী ছিলেন।
তিনি মুসলিম সমাজের অস্পর্শতা, জমিদার, পাঠান ও জোলাসহ অন্যান্য উপাধি নিষিদ্ধ করে সকল মুসলমানকে ভাই ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনিই জোলাহ্দেরকে “কারিগর” খেতাব দেন। তিনি মুসলমানদেরকে ধুতি পরা নিষেধ করে লুঙ্গি-পায়জামা পরার নির্দেশ দিয়েছেন।
দৈনিক দুইবার জিকির করা ও ওয়াজ মাহ্ফিল এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। সরকার ও জমিদারদের অন্যায় আচরণের কারণে তিনি সরকারী ট্যাক্স প্রদানে বাধা দান করেন। বলিষ্ঠ আকারের ও সুন্দর দাঁড়িওয়ালা উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী হাজী শরীয়ত উল্লাহ একজন খাঁটি ও আন্তরিক দ্বীনের দাওয়াত দানকারী ছিলেন। ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ (রহ.) ১৮৪০ সালে ৫৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
0 comments:
Post a Comment