জিন বিজ্ঞাণী মাকসুদুল আলম ফরিদপুরের সন্তান, জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) একজন কর্মকর্তা। মা লিরিয়ান আহমেদ একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহীদ হলে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে মা লিরিয়ান আহমেদের ঘাড়ে। শিক্ষকতা করে তিনি তাঁর চার ছেলে ও চার মেয়েকে গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর মাকসুদ চলে যান রাশিয়ায়। মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরে জার্মানিতে বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট থেকে প্রাণরসায়নে পিএইচডি করেন। মস্কোয় মাকসুদ ভ্লাদিমির পেত্রোভিচ মুলাচেভের সংস্পর্শে আসেন।
পেত্রোভিচের প্রাণরসায়নের নানা শাখায় অবদান রয়েছে। জার্মানিতে তিনি কাজ করার সুযোগ পান প্রাণরসায়নের অন্য দুই দিকপাল ডিয়েটার ওয়স্টারহেল্ট ও জেরাল্ড হেজেলবাউয়ের সঙ্গে। জার্মানির পর তিনি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন বাই প্রডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য মাকসুদ ও তাঁর সহকর্মীদের ১০ লাখ ডলার অনুদান দেয়। ওই সেন্টারে কাজ করার সময় ২০০০ সালে তিনি ও তাঁর সহকর্মী রেন্ডি লারসেন প্রাচীন জীবাণুতে মায়োগ্লোবিনের মতো এক নতুন ধরনের প্রোটিন আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের সুবাদে মাকসুদের খ্যাতি ও দক্ষতা সবার নজরে আসে। হাওয়াইয়ান পেঁপের জিন নকশা উন্মোচনের জন্য ডাক পড়ে তাঁর। এ কাজ সম্পন্ন করার পর বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদে স্থান পান তিনি। পেঁপের জিন নকশা উন্মোচনের পর তিনি পাটের জিন নকশা উন্মোচনের কথা ভেবেছিলেন। সে সময় কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ডাক পড়ে মালয়েশিয়ায় রাবারের জিন নকশা উন্মোচনের জন্য, ওই কাজেও তিনি সফল হন। পরে তিনি মনোনিবেশ করেন পাটের জিন নকশা উন্মোচনে। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা।
যেভাবে পাটের জন্ম রহস্য উদ্ঘাটন : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে পেঁপের জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন হওয়ার পরপরই বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম একদল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং কয়েকজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশের জন্যও একই রকম একটি সাফল্য নিয়ে আসা যায় কি না_এ ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। আর এভাবেই তৈরি হয় স্বপ্নযাত্রার প্রাথমিক দলটি। এরপর প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকে আর্থিক অনুদান জোগাড় করার তোড়জোড়, গবেষণা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা এবং তথ্য পর্যালোচনা। অবশেষে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ঘোষণা দেন, বাংলাদেশেই করা হবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং সরকার এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দেবে। তিনটি ভিন্ন ধারার প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে, অর্থাৎ গবেষণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ডাটাসফট ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সুফলকে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সহায়ক হিসেবে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নিয়ে গঠিত দলটি তাঁদের কার্যক্রম শুরু করে।
সাফল্যের পেছনে এক অনন্য সমন্বয় : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, প্রকল্পটির সাফল্যের চাবিকাঠি হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক অনন্য ত্রয়ী। প্রকল্পটির জীববিজ্ঞানবিষয়ক দিকটির তত্ত্বাবধানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি। ডাটাসফট সাহায্য করেছে আন্তর্জাতিক সহায়তায় জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশাল তথ্যভাণ্ডারকে পর্যালোচনা করার উপযোগী অবকাঠামো তৈরিতে।
জিনোম সিকোয়েন্সিং কী : মাত্র চারটি অক্ষর, অ, ঈ, েও ঞ দিয়ে প্রকাশিত প্রোটিনের বিন্যাসে অণুজীব থেকে শুরু করে বহুকোষী জীব মানুষ_সবার জীবন বিন্যস্ত। কোটি কোটি অ, ঈ, েও ঞ-এর বিন্যাস সমাবেশে লেখা আছে সব প্রাণের নীল নকশা 'জিনোম'। একটি জীবের জিনোমে লেখা থাকে এর সব বৈশিষ্ট্য। তাই জিনোমের সিকোয়েন্স অর্থাৎ কোন অক্ষরের পর কোনটি, তা বের করতে পারলেই জীবনের সব বাক্য, অনুচ্ছেদ পড়া সম্ভব।
মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স বের হয়ে যাওয়ার পর অনেক প্রাণনাশক অসুখের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। একইভাবে একটি উদ্ভিদের সব বৈশিষ্ট্য, এর বীজের গুণগত মান, পুষ্টি, আঁশ উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রভৃতি জিনোমে লিপিবদ্ধ আছে। এ তথ্যগুলোর সব উদ্ধার করা গেলে ওই উদ্ভিদের ফলনে উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়। ধানের জিনোম সিকোয়েন্সের ফলাফলস্বরূপ উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে স্বল্প পানিতে উৎপাদনক্ষম বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার উপযোগী বা অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন ধান। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এরই মধ্যে জিনোম নিয়ে গবেষণার এ সুফলগুলো গ্রহণ করেছে এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশও এ পথ অনুসরণ করছে।
বাংলাদেশ ও পাট শিল্প : বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে উৎপন্ন পাটের জাতগুলো সাধারণত উচ্চ পরিমাণে লিগনিন-সম্পন্ন হয়, যা পাটের আঁশকে টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহার করার পথে বিশেষ বাধাস্বরূপ। পাটের সম্পূর্ণ জিনোম উদ্ধার হয়ে যাওয়ার পরে বিজেআরআই-এর ফাংশনাল জিনোমিকস দলটি লিগনিনের সঙ্গে জড়িত বিশেষ কিছু জিন শনাক্ত করতে পারবে। এর ফলে স্বল্প লিগনিন-সংবলিত উচ্চগুণসম্পন্ন আঁশ উৎপাদন সম্ভব হবে। ছত্রাকের আক্রমণ পাট চাষের জন্য বিরাট হুমকি। জিনোমের সিকোয়েন্স জানা থাকলে ছত্রাকের আক্রমণ প্রতিরোধক পাট উৎপাদন সহজেই সম্ভব হবে, যা দামি ও ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই কমিয়ে আনবে। শীত ও লবণসহনশীল পাটের জাত উদ্ভাবন করা গেলে অব্যবহৃত জমিতে যেমন উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যার ফলে নিট পাটের উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। পাটের পাতায় রয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা নিয়ে এখনো তেমন গবেষণা হয়নি। জিনোম সিকোয়েন্স জানার পর পাটের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরো বেশি জানা যাবে, যার ফলে পাটকে কেন্দ্র করে ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স এবং এর বিভিন্ন মিউটেশন পর্যালোচনা করার মাধ্যমে পাটের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন সম্ভব হবে।
যেসব সুফল পাওয়া যাবে : তন্তু হিসেবে অত্যন্ত কার্যকরী পাটের সোনালি আঁশ। সেই আঁশের দৈর্ঘ্য, রং ও বিশেষ গুণাবলি উন্নয়নের জন্য পাটের জিনোম সিকোয়েন্স করার উদ্যোগটি বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুযোগ বয়ে আনবে। এ উদ্যোগের ফলস্বরূপ উচ্চ ফলনশীল, লবণসহনশীল ও পোকামাকড় প্রতিরোধক পাট উৎপাদনের গুপ্ত সূত্র এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশে জিনোমিক্স ও বায়োইনফরমেটিক্স গবেষণার ক্ষেত্রে এ পদক্ষেপ ব্যাপক ভিত্তি তৈরি করবে।
মাকসুদুল আলম
Info Post
0 comments:
Post a Comment