নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হোসে সারামাগো জন্ম লিসবনের উত্তর-পূর্বে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে আলমন্দা নদীর ডান তীরে রিবাতেজো প্রদেশের এক ছোট্ট গ্রাম আজিনহাগার একটি ভূমিহীন কৃষক পরিবারে ১৬ নভেম্বর, ১৯২২।
সারামাগোই প্রথম পর্তুগিজ লেখক, যিনি নোবেল পুরস্কারে (১৯৯৮) ভূষিত হন। দ্য গসপেল একর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট উপন্যাসের জন্য তিনি ক্যাথলিক সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হন এবং দেশ ছেড়ে স্পেন শাসনাধীন ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করতে থাকেন। এ কালের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তিনি একজন প্রকৃত ‘লেট ব্লুমার’—মধ্যপঞ্চাশেই মূলত লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এই আত্মজীবনী ফার্নান্দো রড্রিগস ও টিম ক্রসফিল্ডের ইংরেজি অনুবাদ থেকে ভাষান্তরিত হয়েছে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি এই আত্মজীবনী রচনা করেন।
তার নাম হবার কথা ছিল হোসে দ্য সুসা কিন্তু নাম নিবন্ধনকারী নিজ উদ্যোগে তার নামের সঙ্গে একটি ডাকনাম লাগিয়ে দিলেন—তার বাবার পরিবার গ্রামে এ নামেই পরিচিত—সারামাগো। এখানে বলা দরকার যে সারামাগো এক ধরনের বন্য গাছ, যার পাতা সেই দিনগুলোতে গরিবদের পুষ্টিসাধনে খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হতো।
১৯বছর বয়সে পর্তুগিজ টেকনিক্যাল স্কুলের কোর্স শেষ করার পর তিনি একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে দুই বছর মেকানিক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় লিসবনের একটি গণপাঠাগারে প্রায়ই আসা-যাওয়া শুরু করেন। পাঠাগারটি সন্ধ্যায় খোলা থাকত। সেখানেই কোনো রকম সাহায্য বা দিকনির্দেশনা ছাড়া কেবল অনুসন্ধিৎসা ও পড়ার ইচ্ছার জোরে তার পড়ায় রুচি তৈরি হলো এবং তা শাণিত হলো। ১৯৪৪ সালে যখন বিয়ে করেন, তত দিনে আমি চাকরিও বদল করেছেন। তখন তিনি সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রশাসন শাখায় গণকর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তার স্ত্রী ইলদা রিইস তখন রেলওয়ে কোম্পানির টাইপিস্ট। অনেক বছর পর সে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্তুগিজ খোদাইশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সালে তার মৃত্যু হয়। ১৯৪৭ সালে তার একমাত্র সন্তান ভায়োলেন্তের জন্মের বছর তিনি প্রথম বই প্রকাশ করি। এই উপন্যাসটির নাম দিয়েছিলেন বিধবা কিন্তু সম্পাদকীয় কোনো কারণে প্রকাশের সময় বইটির নাম দেওয়া হয় পাপের ভূমি—দ্য ল্যান্ড অব সিন। তিনি তারপর স্কাইলাইট নামে আর একটি উপন্যাস লিখেন। এখনো তা অপ্রকাশিত, আরও একটা শুরু করেন কিন্তু কয়েক পাতার বেশি এগোতে পারেননি। এর নাম হওয়ার কথা ছিল হানি অ্যান্ড গল কিংবা লুই সান অব তেদিওস। যখন তিনি প্রকল্পটা বাদ দিলেন, তখনই এর পরিণতি চূড়ান্ত হয়ে গেল—তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তার উল্লেখযোগ্য কিছু বলার নেই। ১৯ বছর পর ১৯৬৬ সালে তিনি পসিবল পোয়েমস প্রকাশনা ও পর্তুগিজ সাহিত্যচক্রে অনুপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৯ সালে আমি বেকার হয়ে যান। তার টেকনিক্যাল স্কুলের একজন সাবেক শিক্ষকের সদিচ্ছার কারণে একটি লোহালক্কড়ের কোম্পানিতে কাজ পান। তিনি ছিলেন সেখানকার একজন ম্যানেজার।
১৯৫০ দশকের শেষ দিকে হোসে একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘এস্তোদিওস কর’-এর উৎপাদন ব্যবস্থাপকের চাকরি নেন। লেখালেখির জগতে ফিরলেন বটে কিন্তু লেখক হিসেবে নয়। এই নতুন কাজ তাকে সে সময়কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কজন পর্তুগিজ লেখকের সঙ্গে পরিচিতি ও বন্ধুত্বের সুযোগ করে দিল। ১৯৫৫ সালে কেবল পরিবারের বাজেট উন্নয়নের জন্যই নয়—তার অবসর সময়ের কিছু অংশ অনুবাদের জন্য বরাদ্দ করেন। এ কাজ তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যাই। যাঁদের লেখা অনুবাদ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: কলেটি, পার ল্যাগার্কভিস্ট, জ্যাঁ কসো, মোঁপাসা, আঁদ্রে বোনার, তলস্তয়, বোদলেয়ার, এতিনে বলিবার, নিকোস পুলানজাস, হেনরি ফসিয়ন, জ্যাক রোমা, হেগেল, র্যায়মন্ড বেয়ার প্রমুখ। ১৯৬৭ সালের মে থেকে ১৯৬৮-এর নভেম্বর পর্যন্ত। এর পর বাকি অংশটুকু তার ডায়রি থেকেই পড়া যাক_
এর মধ্যে ১৯৬৬ সালে আমার প্রকাশিত পসিবল পোয়েমস সাহিত্যে আমার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করে দেয়। এরপর ১৯৭০ সালে আরও একটি কবিতার বই প্রোবাবলি জয় প্রকাশিত হয়। এর স্বল্পকাল পরে ১৯৭১ ও ১৯৭৩-এ খবরের কাগজে প্রকাশিত আমার নিবন্ধগুলোর সংকলন ফ্রম দিস ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড দ্য আদার এবং দ্য ট্র্যাভেলার্স ব্যাগেজ প্রকাশিত হয়। সমালোচকেরা মনে করেন, আমার পরবর্তী সাহিত্যকর্ম অনুধাবনের জন্য বই দুটো গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালে আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর পর্তুগিজ লেখিকা ইসাবেল দ্য নবরেগার সঙ্গে একটি সম্পর্কের সূত্রপাত করলাম, যা ১৯৮৬ পর্যন্ত টিকে ছিল।
১৯৭১ সালের শেষে এই প্রকাশনা সংস্থা ছেড়ে দেওয়ার পর পরবর্তী দুই বছর আমি দিয়ারিও দ্য লিসবন নামক সান্ধ্য দৈনিকে সংস্কৃতিবিষয়ক সংখ্যার ম্যানেজার এবং সম্পাদক হিসেবে কাজ করি।
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত দ্য অপিনিয়নস দ্য ডিএল হ্যাড-এ একনায়কতন্ত্রের শেষ সময়গুলোর একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে—সেই এপ্রিলেই একনায়কতন্ত্রের গদি উল্টে যায়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে আমি সকালবেলার সংবাদপত্র দিয়ারিও দ্য নোতিসাস-এর উপপরিচালক হিসেবে যোগ দিই। নভেম্বর পর্যন্ত আমি এ পদে ছিলাম। তারপর চাকরিচ্যুত হই। ২৫ নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে যে রাজনৈতিক-সামরিক আঁতাতে অভ্যুত্থান ঘটে তা বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়। এ পরিবর্তনের কারণেই আমাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। আমার দুটি বই এই সময়টাকে ধরে রেখেছে: দ্য ইয়ার অব নাইনটিন নাইনটি থ্রি, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ কবিতা যা কোনো কোনো সমালোচকের মতে দুই বছর পর আমার লেখা উপন্যাস ম্যানুয়াল অব পেইন্টিং অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফির আগমন বার্তা এবং নোটস নামে প্রকাশিত গ্রন্থ যাতে সংকলিত হয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো।
আবার বেকার হয়ে যাওয়ায় এবং যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তাতে চাকরি পাওয়ার ক্ষীণতম সম্ভাবনা না থাকায় আমি পুরোপুরিভাবে সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। লেখক হিসেবে আমার মূল্য কতটা, তখনই তা নিরূপণ করার সময়। ১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি আলেন্তেজো প্রদেশের একটি গ্রাম ‘লাভর’-এ চলে যাই। সে সময়টা ছিল পড়াশোনা, নিরীক্ষা আর নোট নেওয়ার। এরই ফলে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত রাইজেন ফ্রম দ্য গ্রাউন্ড উপন্যাসে বর্ণনার যে ধরন তা-ই আমার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপ নেয়। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে আমার একটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। নাম কোয়াসি অবজেক্ট, ১৯৮৯ সালে নাটক দ্য নাইট ও ফ্রম দ্য গ্রাউন্ডের কয়েক মাস আগে একটি নতুন নাটক হোয়াট শ্যাল আই ডু উইথ দিস বুক; এর পর ১৯৮৭ সালে আরেকটি নাটক দ্য সেকেন্ড লাইফ অব ফ্রান্সিস অব আসিসি ছাড়া ১৯৮০ সালের পুরো দশকটাই উপন্যাসে নিবেদিত ছিল: বালতাজার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা ১৯৮২, দ্য ইয়ার অব দ্য ডেথ অব রিকার্ডো রিস ১৯৮৪, দ্য স্টোন র্যাক্ট ১৯৮৬, দ্য হিস্ট্রি অব দ্য সিজ অব লিসবন ১৯৮৬। ১৯৮৬ সালে স্পেনীয় সাংবাদিক পিলার দেল রিওর সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং আমরা ১৯৮৮ সালে বিয়ে করি।
দ্য গসপেল একর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট ১৯৯১-এর ওপর পর্তুগিজ সরকারের সেন্সরশিপ আরোপ এবং গ্রন্থের বিষয় ক্যাথলিকদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানায় প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান লিটারেসি প্রাইজে ভেটো দেওয়া হয়। এ কারণে আমি ও আমার স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে বসবাসের জন্য ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের ল্যানজারোট দ্বীপে চলে যাই। এ বছর ইন নমিনি দিই নামে লিসবনে লেখা একটি নাটক প্রকাশ করি। ইতালীয় সুরকার আজিও কোর্গি এই নাটকটিকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। এর আগেও কোর্গি এগিয়ে এসেছেন, আমার বালতাজার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা উপন্যাস থেকে ব্লিমুন্দা নামে অপেরা মিলানের মঞ্চে উঠিয়েছেন ১৯৯০ সালে।
আমি ডায়েরি লিখতে শুরু করি। ‘ল্যানজারোট ডায়েরি’ পাঁচ খণ্ডে শেষ হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করি আমার উপন্যাস ব্লাইন্ডনেস এবং ১৯৯৭ সালে অল দ্য নেইমস। ১৯৯৫ সালে আমাকে ক্যামোজ প্রাইজ দেওয়া হয় এবং ১৯৯৮ সালে নোবেল প্রাইজ।
হোসে সারামাগো ১৮ জুন, ২০১০ মৃত্যুবরণ করেন।
হোসে সারামাগো
Info Post
0 comments:
Post a Comment