লৌকিক ঐতিহ্যোর অবিস্মরণীয় এক নাম জালাল উদ্দিন খাঁ। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে ১৮৯৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সদরুদ্দীন খাঁ। বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক অবধি প্রাকৃত বাঙালিজনের এই গীতিকবি তার সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। তার সংগীত ভাবনা তথা জীবনদর্শনে দ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। যুগে যুগে তার গান সঞ্চিত আবেগ হয়ে সমকালীন শিল্পীদের কণ্ঠকে করেছে মাধুর্যপূর্ণ।
অখণ্ড বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের যে অংশটিকে ‘পূর্ব ময়মনসিংহ’ বলে অভিহিত করা হয় জালাল উদ্দীন খাঁ সেখানকারই মানুষ। এখনকার পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের কিছুসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদীর বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই সংস্কৃতির পরিমণ্ডল। বিশিষ্ট এই সংস্কৃতি অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল অনেক লোককবি ও লোকগীতিকাব্যের। এরকমই লোককবি ও লোকগীতিক সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ও রাধারমণ, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমহোন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথের প্রত্যক্ষ উত্তরসাধক বিংশ শতাব্দীর জালাল উদ্দীন খাঁ।
অনিকেত মানুষের এই লোককবি প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন এ অঞ্চলেরই আরেকজন প্রখ্যাত লোককবি ও গীতিকার রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। জালালের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন তিনি। অগ্রজ এই কবির বাড়ি ছিল নেত্রকোনা শহরের পাশের গ্রাম বাহিরচাপড়ায়। বাড়িতে থেকে জালাল খাঁ কিছুদিন নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রেই রশিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে জালালের কবিপ্রতিভা তথা সংগীতপ্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। রশিদ উদ্দিন ছাড়াও ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ অঞ্চলে জালালের সমসাময়িক অগ্রজ ও অনুজ কবি-গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন- উকিল মুন্সি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার। এদেরই ধারাবাহী কবি-গীতিকারদের মধ্যে এখনও সক্রিয় আছেন খোরশেদ মিয়া, মিরাজ উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম এবং মহিলা কবি আনোয়ারা বেগম।
জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’ জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নামগুলো হলো- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। ‘জালালগীতিকা’র অধিকাংশ গানই এরকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন- ‘জালাল গীতিকা’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান ‘ভাটিয়ালি’ নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই ‘ভাটিয়ালি’। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে, আর ১৪টি ‘মুর্শিদি’ ও ১১টি ‘মারফতি’ নামাঙ্কিত গান। ‘জালাল গীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হতে ‘জালাল গীতিকা’র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়।
জালাল যদিও বাউল কবি বা বাউল গীতিকাররূপে পরিচিত, তবু মনে রাখা প্রয়োজন যে বাউল হচ্ছে বাংলার একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালির নাম এবং এই নামের বিশিষ্ট সাধন প্রণালিটির সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তবে তা না থাকলেও, বাউলসহ সকল লৌকিক ধর্মেরই অন্তঃসার যে বিদ্রোহী চেতনা, সে চেতনাই জালাল গীতি পুরোপুরিই ধারণ করেছে। তাই তার গানেও এই বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে অজান্তেই সমকালীন সময়ে জালাল রচিত সংগীতের ধারাটিকে সজীব রাখছেন সারা দেশের অনেক গায়ক। এদের মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুরের আবুল কাশেম তালুকদার ২০০৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন। অন্ধ গায়ক সুনীল কর্মকার এ দেশে তো বটেই, মার্কিন দেশে গিয়েও জালাল গীতি পরিবেশন করে রসিকজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জালালের শেষতমা পতœীর গর্ভজাত পুত্র আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও তার সাধনার ধারাকে আপন সাধ্যমতো বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন।
জালাল উদ্দিন ‘মালজোড়া’ গানের আসরে অংশগ্রহণ করে প্রভূত কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ‘মালজোড়া’ হচ্ছে বাউল গান পরিবেশনেরই একটি বিশেষ রীতি বা প্রকরণ। ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বাসাটি গ্রামে এক মালজোড়া গানের আসরে জালাল উদ্দীন খাঁ ‘ধরাট’ বা প্রশ্ন রেখেছিলেন ‘আল্লা বলতে কেউ নাই এ সংসারে /মিশে গেছে আলো হাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে?’ জালালের প্রতিপক্ষ বাউল ইদ্রিস এই ধরাটের উত্তর দিয়েছিলেন নেত্রকোনার আরেক প্রখ্যাত বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের একটি গানের সাহায্য নিয়ে- ‘জালাল তুমি ভাবের দেশে চল-আল্লাকে দেখবে যদি চর্মচক্ষের পর্দা খোল/ গিয়া তুমি ভাবনগরে চেয়ে থাকো রূপ নেহারে, সজল নয়নে ফটোগ্রাফ তোল/মনরঙে প্রেমতরঙ্গে তোমার দিলের কপাট খোল/দেখবে তোমার মাবুদ আল্লা সামনে করে ঝলমল।’ এখানে যে ধরণের যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, সে ধরনের যুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়েই লোকসমাজের কবি গীতিকাররা তাদের স্বাধীন চিন্তার উৎসারণ ঘটিয়ে থাকতেন। জালাল রচিত গীতিগুলোতেও এ রকমই স্বাধীন চিন্তা ও বিদ্রোহী চেতনার স্পষ্ট ও সার্থক অভিব্যক্তি ঘটেছে। জালালের সংগীত ভাবনা তথা জীবনদর্শনে দ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। ‘সীমার মাঝে অসীম’ এর বোধটিও এবং ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ এর ধারণাটিও, জালালের গানে অভিব্যক্তি পেয়েছে। একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষের মতোই তিনি লক্ষ করেছেন যে ধর্মব্যবসায়ীরা জনসাধারণের আত্মজ্ঞান লাভের পথে বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভাষা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত রাখতে চেয়েছে। তাইতো তিনি বলেছেন, ‘বিজাতি ইংরেজি শিক্ষায় বেহেশ্ত না পাওয়া যায় মোল্লাজিদের কথা শুনে শিখল না মানুষে, সকল ভাষা সমান বুঝে ধর এবার কষে- কবে আবার সুদিন উদয় জালালে কয় চল্ সাহসে । যেসময়ে পল্লির মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণকে পাপ বলে মনে করেছে, সে সময়েই জালাল বলেছেন, ‘জন্মনিরোধ না করিলে সুখ পাবে না এ-সংসারে।’
শুধু গ্রাম-গঞ্জের অজ্ঞাত-অখ্যাত গায়কদের কণ্ঠেই নয়, আব্বাস উদ্দিন ও আবদুল আলিমের মতো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীও জালালের গান রেকর্ড করেছেন। সে রকমই কয়েকটি গান হলো- ‘ও আমার দরদি আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’, ‘আরেও ভাইট্যাল গাঙের নাইয়া’, ‘দয়াল মুর্শিদের বাজারে’, ‘সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি’ এসব গান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এগুলোর রচয়িতা যে জালাল উদ্দীন খাঁ এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি অনেকেরই অজ্ঞাত। শুধু আত্মতত্ত্ব কিংবা পরমতত্ত্ব নয়, জালালের গানে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তিও ঘটেছে- ‘জীবন আমার ধন্য যে হায় জনম মাগো তোমার কোলে স্বর্গ যদি থেকেই থাকে/বাংলা মা তোর চরণ মূলে’, ‘হেথা আমি কুসুম সাথে জনম নিলাম অরুণ প্রাতে/শুয়ে ঘাসের গালিচাতে মরণ যেন হয় বিভোলে। মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া তোমার মনে মিশাইয়া রেখ আমায় যুগে যুগে জালালে কয় পরাণ খুলে।’ গেল শতাব্দীর শেষভাগে জালাল উদ্দীন খাঁর জীবন ও সংগীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেশকিছু গুণীজন। ১৯৯০ সনে বাংলা একডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজিজুল হক চৌধুরী’র জীবনীগ্রন্থ ‘জালাল উদ্দীন খাঁ’। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০ সনে ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ ও ২০০১ সনে ‘জনপদাবলি’ নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম গ্রন্থটিতে জালালের ১০টি ও দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে তার ১৩টি গান সংকলিত হয়েছে। দুটো গ্রন্থের ভূমিকাতেই জালালের সংগীত সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। সুধীর চক্রবর্তীর ‘জালাল-গীতি: ‘কত রঙের নকশি কাঁথা’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নাঈম হাসান-সম্পাদিত লিট্ল ম্যাগাজিন ‘নিরন্তর’-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় পৌষ, ১৪১২ সালে। এছাড়া যতীন সরকার সম্পাদিত ‘জালালগীতিকা সমগ্র’ একটি দুর্লভ প্রকাশনা। লোকমানুষের মরমি এই শিল্পী ১৯৭২ সালে তার সাধনার আত্মতত্ত্ব থেকে স্পর্শ করেন পরমতত্ত্বে।
রুদ্র মাহ্ফুজ
জালাল উদ্দিন খাঁ
Info Post
বাউল জালাল খাঁ সম্পর্কে আমার প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। তার ক্ষুদ্র অংশ এখান থেকে মেটাতে পারলাম।
ReplyDeleteখোদা থুইয়া মানুষ ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে? মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে................জয় গুরু
ReplyDeleteClick to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.