Breaking News
Loading...
Friday, June 18, 2010

সুবোধ ঘোষের অনন্যতা চিহ্নিত হয়েছিল তাঁর প্রথম লেখা গল্পেই। বাংলা সাহিত্যে অবলা জীব বা মানবেতর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের আবেগের সংশিস্নষ্টতা নিয়ে গল্প রচিত হয়েছে অনেকগুলো। শিল্পোত্তীর্ণ গল্পের তালিকায় রয়েছে শরৎচন্দ্রের 'মহেশ', প্রভাতকুমারের 'আদরিণী', তারাশঙ্করের 'কালাপাহাড়'। এছাড়া রয়েছে একটি বৃৰের সমবয়সী ও বৃৰের সঙ্গে বেড়ে ওঠা বালকের আবেগকেন্দ্রিক গল্প রবীন্দ্রনাথের 'বলাই'। কিন্তু কোনো যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িত হয়ে পড়ার ঘটনা বাসত্দবেও যেমন কম, সাহিত্যেও তেমনই কম। এ-যাবৎ সৃষ্ট একমাত্র শিল্পসম্মত গল্প সুবোধ ঘোষের 'অযান্ত্রিক'। আরও বিস্মিত হবার মতো তথ্য হচ্ছে 'অযান্ত্রিক'-ই নাকি সুবোধ ঘোষের লেখা প্রথম ছোট গল্প।

'অযান্ত্রিক' লেখার আগে তিনি কখনো কলম ধরেন নি। তাঁর জীবনী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই গল্প লেখার আগে সাহিত্য সংক্রানত্দ কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অবকাশ বা সুযোগ ইতোপূর্বে তাঁর জীবনে ছিল না।

১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের হাজারিবাগে। স্কুলের শিৰাও সেখানে। সেটি সমাপ্ত করে হাজারিবাগেরই সেন্ট কলম্বাস কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু আর এগুনো সম্ভব হয় নি। অর্থাভাবে স্কুলে ডবল প্রমোশন পাওয়া এই মেধাবী ছাত্রকে নামতে হয়েছিল জীবিকার সন্ধানে। হাজারিবাগের কুলি বসত্দিতে তখন মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। পনেরো বছর বয়সের সুবোধ ঘোষ সেখানে কাজ পেলেন। টীকা দেয়ার কাজ। এই টীকা দেয়ার কাজেই তাঁকে এক সময় যেতে হয়েছিল বোম্বাই (বর্তমানের মুম্বাই) এবং তারপর সুদূর এডেন বন্দরে। সেই কাজ শেষ হওয়ার পরে সার্কাস পার্টিতে লটবহর- বাক্স-প্যাটরা বহনের কাজ করেছেন কিছুদিন। মোটর কোম্পানির কনডাক্টর হয়ে রাঁচি-গয়া বাস সার্ভিসে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন বিপদসঙ্কুল অভ্রখনিতে ওভারসিয়ার হিসেবে। পাউরম্নটি-কেক দোকানে-দোকানে সাপস্নাই করেছেন কিছুদিন। তারপরে হোটেলের ব্যবসা. মুরগি পালন, মিষ্টির দোকান, মাখনের দোকান। এর মাঝে কিছুদিন সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জনপদ থেকে জনপদে।

অর্থাৎ জীবন ও জীবিকার বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ঝুলিটি পূর্ণ করে একটু বেশি বয়সেই কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন সুবোধ ঘোষ। অনামী সংঘের বৈঠকে পাঠের জন্য বন্ধুদের অনুরোধে হঠাৎ লিখে ফেলা 'অযান্ত্রিক' আকস্মিক হলেও কোনো পূর্বপ্রসত্দুতিহীন রচনা নয়। যদিও নিজের কাছেও পরবর্তীতে বিস্ময়কর মনে হয়েছিল তাঁর লেখক হয়ে উঠার আকস্মিকতা। তখন পর্যনত্দ আনাড়ি একজনের পৰে গল্প লেখা সম্ভব হলো কেমন করে? এই প্রশ্নও দেখা দিয়েছিল যে, ব্যক্তির জীবনের যোগ্যতাও কি একটি আকস্মিক আবেগের সৃষ্টি? উত্তরও খুঁজে পেয়েছিলেন। নিজেই লিখেছেন- 'সেদিন যে বাসত্দব সত্যতার নিয়মটাকে স্পষ্ট করে ধরতে ও বুঝতে পারি নি, আজ সেটা খুব স্পষ্ট করে ধরতে ও বুঝতে পেরেছি বলেই বলতে পারি, না, আমার গল্প লেখার কৃতিত্বটা বিশুদ্ধ আকস্মিকতার একটা ইন্দ্রজালের জাল নয়। ভাবনা, কল্পনা ও অনুভবের মধ্যে জীবন-বৈচিত্র্যের যে ছবি আগেই রূপানত্দরিত হয়েছিল, তারই প্রতিচ্ছবি একদিন গল্পরূপে বিমূর্ত হয়েছিল।' (প্রবন্ধ: সেদিনের আলোছায়া ।।গ্রন্থ: সুনির্বাচিত।।)।

বিনা প্রস্তুতিতে কেউ যে লেখক হতে পারে না, স্বভাব-অলস বাঙালিগণচিনত্দার বিপৰে দাঁড়িয়ে এই সত্যটি আবার ঘোষণা করলেন সুবোধ ঘোষ। জানিয়ে দিলেন, 'অযান্ত্রিক'-এর আগে অন্য কোনো সাহিত্য রচনা না করলেও লেখার প্রসত্দুতি তাঁর ভেতরে ভেতরে চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। ছিল বিশাল পাঠপ্রসত্দুতি। দার্শনিক মহেশচন্দ্র ঘোষের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি উন্মুক্ত ছিল তাঁর জন্য। সেই বিশাল ভাণ্ডার থেকে পাঠ করেছেন ইতিহাস-দর্শন-ধর্মতত্ত্ব; নৃতাত্তি্বক শরৎচন্দ্র রায়ের সানি্নধ্যলাভ ও তাঁর গবেষণা-কর্মগুলো পাঠ করে ধারণা লাভ করেছেন ভারতবর্ষের আদিবাসী জনজাতি সম্পর্কে; জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর পার্বতীলাল দত্ত-র কাছে শুনতে পেয়েছেন নদী-পাহাড়-সমুদ্র-পাথর-ফসিলের পাঠোদ্ধারের গল্প; কৈশোরে সানি্নধ্য পেয়েছেন সম্মানীয়া মহিলা কবি কামিনী রায়ের, কবির স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনেছেন তাঁর অনেক কবিতার। সব মিলিয়ে বলা যায় একদিকে যেমন তার মধ্যে জমা হচ্ছিল জ্ঞানশাস্ত্রের বিভিন্ন অধ্যায়, অন্যদিকে জীবন তাকে শেখাচ্ছিল বেঁচে থাকার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বা অব্যাহত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কলাকৌশল। লেখকের পূর্বপ্রস্তুতির জন্য এসবের চাইতে বড় শিৰক ও তত্ত্বাবধায়ক আর কী হতে পারে!

১৯৪০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্ষিক দোল সংখ্যায় প্রকাশিত হয় 'অযান্ত্রিক'। লেখকের প্রথম লেখা ও প্রথম প্রকাশিত গল্প। একটি যন্ত্র, একটি গাড়ি যে গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে পারে তা এই প্রথম দেখা গেল বাংলাসাহিত্যে। গাড়িটির একটি নামও আছে। জগদ্দল। অতি পুরাতন, লক্কড়ঝক্কর গাড়ি। শ্রী ও শক্তি কোনোটিই তেমন নেই। চলার সময় সবচেয়ে বেশি ধুলো ওড়ায়, বিকট শব্দে পথের মোষ ৰ্যাপায়। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেবার সঙ্গে-সঙ্গে জগদ্দলের গর্জনে পানের দোকানের লাল জলের বোতলগুলি কেঁপে ওঠে ঠুং ঠুং করে। এতই পুরানো গাড়ি যে চলার সময় তাকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক জন্তু গোঁ গোঁ করে ছুটে আসছে। তালিমারা হুড, সামনের আরশি ভাঙা, তোবড়ানো বনেট, কালিঝুলি মাখা পর্দা আর চারটি চাকার টায়ারে পট্টি লাগানো। পাদানিতে পা দিলে মাড়ানো কুকুরের মতো ক্যাঁচ করে শব্দ ওঠে। গাড়ির দশা এমনই শ্রীহীন যে উড়নত্দ চিলগুলো বেছে-বেছে ঠিক জগদ্দলের মাথার উপর মলত্যাগ করে। পথচারী লোকেরা পান খেয়ে হাতের চুনটি নিঃসঙ্কোচে জগদ্দলের গায়েই মুছে দিয়ে সরে পড়ে।

এতকিছু সত্ত্বেও মালিক বিমল জগদ্দলকে ত্যাগ করে নতুন গাড়ি নিতে রাজি নয়। আর এখানেই মানুষের স্নেহ বিতরণের এক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়ে পড়ে। জগদ্দলের প্রতি মানুষের স্নেহ-মমতা-কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসা শেষ পর্যনত্দ যাকে বিজয়ী ঘোষণা করে, তার নাম মানুষ। কেননা মানুষই পারে সব যুক্তি বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসতে।

এই গল্পেরই অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র রূপ আমরা পরবতর্ীতে দেখতে পেয়েছি বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদনত্দী-পুরম্নষ ঋতি্বক কুমার ঘটকের হাতে।

সুবোধ ঘোষের লেখা দ্বিতীয় গল্প 'ফসিল'। ঐ একই বছরে অথর্াৎ ১৯৪০ সালে রচিত। এই গল্পের বিষয়বসত্দু সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু গল্পের বিন্যাস, ছোট-ছোট শেস্নষের ব্যবহার, তীৰ্ব শব্দের প্রয়োগ, গল্প এগিয়ে চলতে চলতে অবিশ্বাস্য বাঁক বদলের কারিগরি- এসব দেখে স্পষ্টই বোঝা যায়, বাংলা ছোটগল্পে সুবোধ ঘোষীয় একটি ঘরানা তৈরি হতে যাচ্ছে। নিজের মতো করে দেশ, সমাজ, মানুষ ও সমকালকে ধরতে চেষ্টা করছেন সুবোধ ঘোষ। সেই সময় গ্রামের শোষকশ্রেণী এবং বিদেশী ইংরেজ শাসকের প্রত্যৰ শোষণ ও অবিচারে গ্রামবাংলার চাষী জমিজমা হারিয়ে সর্বস্বানত্দ হয়ে পড়ছে, রম্নজি-রোজগারের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে আসছে শহর ও শহরতলীতে। শহরের শিৰিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আগে থেকেই ভুগছিল বেকারত্ব ও আর্থিক অনটনে, তা বেড়ে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে এই চাপের ফলে, শহরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুমর্ূল্য ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে, নাগরিক দূষণ দেখা দিচ্ছে ব্যাপকভাবে, গ্রামের বৃনত্দচু্যত মানুষ শহরে এসে ছোটখাট ব্যবসা-চাকরি-শ্রমিক-মজুরের কাজ সংগ্রহ করার চেষ্টায় প্রাণানত্দ, আর্থিক বিপন্নতার দরম্নন চুরি-জোচ্চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ দুর্বিষহ করে তুলছে নাগরিক জীবনকে, ঘটছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছাঁটাই-মজুরি হ্রাস ভেঙ্গে দিচ্ছে শ্রমিকের জীবনের মেরম্নদণ্ড। চলছে দুর্ভিৰ, যুদ্ধ, কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণ। দেশের মানুষের মূল্যবোধ উৎপাটিত হচ্ছে সমূলে। আর এই সবকিছুকে ধারণ করছেন সুবোধ ঘোষ একের পর এক ছোটগল্পে। লিখিত হচ্ছে 'সুন্দরম', 'গোত্রানত্দর', 'পরশুরামের কুঠার', 'ম তস্থৌ', 'গরল অমিয় ভেল', 'উচলে চড়িনু' 'বৈর নির্যাতন', 'কালাগুরম্ন' 'কাঞ্চনসংসর্গাৎ', 'চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ'।

সারা বিশ্বে আজ আদিবাসী ইসু্য দিকে দিকে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। শুধু আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজেরাই নয়, সংবেদী বিবেকবান প্রগতিশীল সকল মানুষই আজ আদিবাসীদের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন নতুন দৃষ্টিতে। নিজেদের মাটিতেই অপাংক্তেয় ও প্রানত্দিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া এই ভূমিসনত্দানরা বৈরি পৃথিবীতে টিকে আছে শুধুমাত্র নিজেদের প্রাণশক্তি ও অনত্দর্নিহিত বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক বন্ধনের শক্তিতে। শত শত বছর ধরে তারা শুধু লুণ্ঠিত হতে দেখেছে নিজেদের ভূমি, নিজেদের বন-জঙ্গল-পরিবেশ, নিজেদের কৃষ্টি ও নিজেদের নির্মিত সভ্যতার নির্যাসটুকু। বিদ্রোহ করেছে বারংবার। আমাদের ভূখণ্ডেই সাঁওতাল, ত্রিপুরা, মুণ্ডা, ভূমিজ, চোয়াড় জনগোষ্ঠী বিদ্রোহে-বিপস্নবে-বীরত্বে-আত্মত্যাগে বারংবার লাল করে দিয়েছে কালো পলিমাটির ব-দ্বীপ। কিন্তু কখনোই সমাজের মূলধারার জনগোষ্ঠী কোনো নৈতিক সমর্থন নিয়ে দাঁড়ায়নি তাদের পাশে। তথাকথিত সভ্য মানুষ, মানবাধিকার গোষ্ঠী বা সংগঠন কেউই মানবিক সংবেদনার হাত বাড়িয়ে দেয়নি তাদের দিকে। আমাদের দেশে ইউরোকেন্দ্রিক সভ্যতা ভাবনায় আচ্ছন্ন তথাকথিত শিৰিত মানুষের চোখে আদিবাসীরা অসভ্য ও জংলী জনগোষ্ঠী, তাদের মানবেতর প্রাণী থেকে মানুষে উত্তরিত হওয়ার বিবর্তন সম্পূর্ণ হয়নি এখনও। তাই তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনে নির্বিকার থাকতে পারে এই ভুখণ্ডের মূলধারার মানুষ। এতে লজ্জিত হওয়ার মতো কিছু আছে বলে তখনও ভাবতে শেখেননি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। বর্তমানে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আনত্দর্জাতিক ফোরামগুলোর অব্যাহত প্রচারণা আমাদের দৃষ্টিকে আদিবাসীদের দিকে ফিরতে বাধ্য করেছে। কিন্তু প্রকৃত সংবেদনশীল শিল্পী যে আদিবাসীদের শোষণ-বঞ্চনায় নিশ্চুপ থাকতে পারেন না, তার প্রমাণ মিলবে অনূ্যন সত্তর বছর পূর্বে লেখা সুবোধ ঘোষের 'চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ' গল্পে। ইংরেজদের শাসনামলে ভারতবর্ষের নানা প্রানত্দে যে আদিবাসী গণ-আন্দোলনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেগুলোর পেছনে অর্থনৈতিক-সামাজিক কারণের পাশাপাশি আদিবাসী ধর্ম ও সংস্কৃতি রৰার আবেগও তীব্রভাবে জড়িয়ে ছিল। কোনো কোনো বিদ্রোহে স্ফুলিঙ্গের দায়িত্ব পালন করেছিল পাদ্রিদের দ্বারা সংঘটিত খ্রীষ্টধর্মের প্রচার-পীড়নও। এদেশের শিৰিত ভদ্র শ্রেণী যেমন আদিবাসীদের আবেগের গতিরেখা খুঁজে পায় না, তেমনি আদিবাসীরাও বিমূর্ত আন্দোলনের চেহারা অনুধাবন করতে পারে না। এই অপারগতাকে আমরা তাদের দেশপ্রেমহীনতা বলে মনে করি। যেমনটি মনে করেছিল 'চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ' গল্পের উত্তমপুরম্নষ বা কথক-

'নন-কো অপারেশনের ঝড় বইলো সারা দেশে। আমরা স্কুল ছাড়বো। জালিওয়ানওয়ালাবাগের অপমান আমাদের অশানত্দ করে তুললো।

আমরা বাঙ্গালী ও বিহারী ছেলেরা স্কুল ছাড়লাম। রাজার ছেলেরা কেউ ছাড়লো না। খৃষ্টান ছেলেরাও নয়- টুডু টিপগা বেসরা খাল্খো কেউ নয়। আমরা পিকেটিং করে ওদের বাধা দিতে লাগলাম।

আমাদের খুব ভরসা ছিল, হোরো আমাদের দলে আসবে। ফাদার লিন্ডন যেভাবে ওকে অপমান করেছে, জীবনে সে আর কোন পাদরী বা সাদা-চামড়াকে সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

আমরা স্কুলের ফটকে পিকেটিং করছিলাম। দেখলাম হোরো আসছে। -স্বতন্ত্র ভারত কি জয়! জয়ধ্বনি করে আমরা হোরোকে অভ্যর্থনা জানালাম।

হোরো এগিয়ে এসে ইন্দুকে একটা ধাক্কা দিল, পরেশের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। বন-শূয়োরের মত গোঁ গোঁ করে পথ করে নিয়ে ক্লাসে গিয়ে ঢুকলো। সেইদিন হোরোকে আমরা চিনলাম। পাদরীদের ক্রীতদাস, মনুষ্যত্বহীন, মর্যাদাশূন্য, মুর্খ জংলী হোরো। স্বতন্ত্র ভারতবর্ষকে চিনলো না, একটু শ্রদ্ধা করলো না। চিনলো শুধু ওর জঙ্গলকে। কিন্তু তোর জঙ্গল যে ভারতবর্ষের মধ্যেই রে বনবৃষ! ভারতবর্ষের বাইরে তো নয়!'

গল্পের ভদ্র বাঙালি কথক কিন্তু বিপ্রতীপ অবস্থাটির কথা একবারও উচ্চারণ করে না। ভারতবর্ষের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও হোরোদের ঐ এক টুকরো জঙ্গলের সংগ্রামে কি ভদ্রলোকেরা কোনোদিন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? তাই নিজেদের লড়াই তারা নিজেরাই লড়ে। এবং নিজেদের ধরনেই লড়ে-

'শুনলাম মোরাঙ্গি পাহাড়ে একটি হাঙ্গামা হয়ে গেছে। মাটির গির্জাটি ভেঙ্গে ধুলো করে দিয়েছে। কে করেছে?

কে করেছে তাকে আমরা স্বচৰে দেখলাম। বুড়ো সোখা। সেসন জজের আদালতে ভীড়ের মধ্যে মাথা গুঁজে আমরাও রায় শুনলাম- বুড়ো সোখার যাবজ্জীবন দ্বীপানত্দর।'

ইংরেজদের অনুকরণে এদেশের শিৰিত শ্রেণীও ভাবে- বিরসাইট মুণ্ডারা অত্যনত্দ সন্দেহভাজন জীব। প্রতি বছর হাঙ্গামা বাধায়। পুলিশকে ব্যতিব্যসত্দ করে। জঙ্গল আইন মানে না, মহাজনদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে চায় না। বাজারে বসলে তোলা দেবে না। জমি ক্রোক করতে গেলে আদালতের পেয়াদাকে টাঙি নিয়ে কাটতে আসে। একবার স্বরাজ ঘোষণা করেছিল বিরসাইট মুন্ডারা। পাদ্রিকে মেরেছে, পুলিশকে মেরেছে, অনেকগুলি পুল ভেঙ্গেছে।

সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় হোরো। বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সে বলে- 'আমাদের জঙ্গলে কাটরে থেকে অনেক পাপ এসে ঢুকেছে। তাই বিরসা ভগবান আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন।'

স্টীফান হোরোদের পৰে দাঁড়ায়নি দেশের তথাকথিত সভ্য ও শিৰিত মানুষরা। তাই অসমযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে নিতে হয় স্টীফান হোরোদের। গল্পে বলা হয়- 'কাউকে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করবে, একটা ভুলের স্মৃতি কিছুৰণের জন্য কাঁটার মতো মনের মধ্যে বিঁধছিল, হয়তো আমরাই নিরেপেৰ থেকে চতুর্থ পানি পথের যুদ্ধে স্টীফানকে হারিয়ে দিলাম। স্টীফানও বনবাসে চলে গেল।'

এই গল্পপাঠের সঙ্গে সঙ্গে দু'টি বেদনাদায়ক সত্য নিজের সমসত্দ আবরণ সরিয়ে পাঠকের সামনে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভদ্রলোক ও ছোটলোক, শিৰিত মধ্যবিত্ত ও শিৰিত আদিবাসীদের মধ্যে যে মানসিক-সামাজিক ব্যবধান তৈরি হয়েছিল, তা আমরা দুই-দুইটি স্বাধীনতা অর্জনের এতদিন পরেও মুছে ফেলতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত মানসিকতা কিছুটা অপরাধবোধ ও আত্মগস্নানিতে ভুগলেও নিজের শ্রেণী ও গোত্রাভিমান ত্যাগ করে নির্যাতিতদের সারিতে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মনোবল এখনও আত্মস্থ করতে শেখেনি। সুবোধ ঘোষের এই আত্মসমালোচনা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।

শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন- 'যদি কোনদিন আধুনিক জীবনের মহাকাব্য আবার রচিত হয়, তবে ছোট গল্পই তাহার উপকরণ যোগাইবে।'

সুবোধ ঘোষের ছোটগল্প এই দাবির যথার্থ ও ঋজু প্রমাণ। তিনি অতুলনীয় ভাষাশিল্পী। জ্ঞানবিজ্ঞান, যন্ত্রজগৎ, অথনীতি, দর্শন, শরীরবিজ্ঞান, ভূগোল-নৃতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ের পরিভাষা ও শব্দ তার ছোটগল্পে যেভাবে উপমায়, বর্ণনায় ও ব্যঞ্জনায় বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে, বাংলা ছোটগল্পে তার সমকৰতা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বাংলা ছোটগল্পের ভাষাকে সুবোধ ঘোষ যে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তার পটভূমিতে আছে তার বিজ্ঞাননিষ্ঠ বাসত্দব জীবনজিজ্ঞাসা এবং সমৃদ্ধ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন কবিদৃষ্টির ক্লাসিক গাম্ভীর্য। আর সেই কারণেই সুবোধ ঘোষ এখনও লেখকদের লেখক। এই সনামধন্য লেখক ১৯৮০ সনে ইহধাম ত্যাগ করেন।

0 comments:

Post a Comment