Breaking News
Loading...
Wednesday, July 28, 2010

কারো কারো কাছে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক ভাবাদর্শের এক শক্তিমান কবি। আবার কারো কারো কাছে তার পরিচয় ছিল বিদ্রোহের অনন্য প্রতিনিধি হয়ে ওঠা এক শক্তিমান মানুষ হিসেবে। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে একজন পাবলো নেরুদাকে নানা সময় আর নানা কালের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন তার কাব্য সৃষ্টির সক্ষমতার কারণেই। এমনকি গোটা বিংশ শতকের সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবেও তাকে আখ্যায়িত করেছেন শিল্প-সাহিত্যের প্রভাবশালী অনেক বোদ্ধা।
১৯০৪ সালের ১২ জুলাই পারাল নামে চিলির একটি শহরে জন্ম হয়েছিল পাবলো নেরুদার। যদিও নেরুদা ছদ্মনামের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষটির প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা প্রথমে তার ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এ ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পেছনে দুটি কারণ ছিল- প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি; দ্বিতীয়ত, এ নামের আড়ালে তিনি তার কবিতাগুলো নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তার পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। চাকরি করতেন রেলওয়েতে। তিনি চাইতেন তার পুত্র কোনো ‘ব্যবহারিক’ পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস হলেন পল ভারলেইন।

নেরুদার জন্মের কিছু দিন পরেই তার স্কুলশিক্ষিকা মা মারা যান। কয়েক বছর পর ছোট্ট নেরুদাও বাবার সঙ্গে চলে আসেন টিমুকো শহরে। নেরুদার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরোটা কাটে এই টিমুকোতেই। মাত্র তেরো বছর বয়েসেই লেখা ছাপানো আর ষোলো বছর বয়স থেকে পুরোদস্তুর লেখিয়ে বনে যান নেরুদা। টিমুকো শহরেই কবি এবং শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের সঙ্গে পরিচয় হয় নেরুদার। তার প্রত্যক্ষ উৎসাহে নেরুদার কবিতাচর্চাও পায় নতুন মাত্রা।

১৯২১ সালে শিক্ষক হবার সংকল্প নিয়ে চিলির রাজধানী সানতিয়াগোতে অবস্থিত চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখবেন বলে। তবে ফ্রেঞ্চ ভাষার পাঠের চাইতে এ সময় কবিতাতেই অনেক বেশি বুঁদ হয়ে থাকেন নেরুদা। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় তরুণ নেরুদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গোধূলির বই’। আর এর ঠিক এক বছর পরেই প্রকাশিত হয় নেরুদার তুমুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি বেপরোয়া গান’। এতে ছিল ভালোবাসা-প্রেম ও যৌবনের আবেদন। এ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক-বিতর্ক। প্রশংসা করেন অনেকেই। আবার সমালোচনাও কম হয়নি।

১৯২৭ সালে সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে আর্থিক অনটনের কারণে বার্মায় চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে একই দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন সিলোনের কলোম্বোয়, বাটাভিয়ায় (জাভা) ও সিঙ্গাপুরে। ১৯৩৪ সালে তিনি চিলির রাষ্ট্রদূত হয়ে স্পেনে যান। তবে যতই সরকারি কাজ থাক না কেন, কবিতা লেখাও চলছিল। স্পেনে থাকাকালীন সময়ে সেখানকার বিদগ্ধ কবি লোরকার কাজের সাথে পরিচয় ঘটে নেরুদার। স্পেনিশ জাতীয়তাবাদীরা লোরকাকে প্রতিহত করলে সইসব প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন চলছিল। নেরুদাও প্রথমে স্পেনে এবং পরে ফ্রান্সে এই সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। এছাড়া নেরুদার কূটনৈতিক জীবনের আরেক উল্লেখযোগ্য দিক জাভায় মারিকা অ্যান্টোনিয়েটা হ্যাগেনার ভোগেলসাং নামে এক ডাচ তরুণীর সাথে তার সাক্ষাৎ। ব্যাংককর্মী মারিকাকে বিয়েও করেন নেরুদা। তবে মারিকা ও নেরুদার দাম্পত্য জীবনে সুখের বসবাস ছিল না বলেই ১৯৩৬ সালে পৃথক হন তারা। মারিকা ছিলেন ব্যাংককর্মী। বিয়ে করেন তাকে। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। ১৯৩৬ সালে তারা পৃথক হয়ে যান।

১৯৪২ সালে নেরুদা রচনা করেন ‘কান্তো আ স্তালিনগ্র্যাদো’ নামে একটি কবিতার বই। ১৯৪৩ সালে ‘নুয়েভো কান্তো দে আমোর আ স্তালিনগ্রাদো’ নামে আরেকটি বই রচনা করেন। এ দুটো কবিতায় তার কমিউনিস্ট চেতনা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পায়। এ সময় তিনি চিলির রাষ্ট্রদূত হয়ে মেক্সিকোতে ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৪ মার্চ আতাকামা মরু অঞ্চলের আন্ডোফাগাস্তা ও তারাপাকা প্রদেশের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে সিনেটর নির্বাচিত হন নেরুদা। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন তিনি। ১৯৫৩ সালে পান স্তালিন শান্তি পুরস্কার পান।
তার কবিতায় দ্রোহের পঙ্ক্তিমালা ছিল। ছিল চির প্রত্যাশিত মুক্তির আকাক্সক্ষাও। অথচ দুনিয়াজোড়া মানুষকে কবিতার শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে স্বপ্ন দেখানো পাবলো নেরুদা সচেতনভাবে নিজেকে কবি অভিধাতেও অভিহিত করতে চাইতেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি কবিতা লিখি না। আমি কবিও নই। আপনারা আমাকে কেন কবি বলেন, তা আমি জানি না। আমি শুধু শ্রমিকের স্যাতস্যাতে ঘামের গন্ধ নিতে চেষ্টা করি, শোরারের গর্ত থেকে (ক্ষীণ থেকে) শ্রমিক যখন উঠে এসে একটু বিশ্রাম নেয় তখন তার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি, তাদের জীবন ও জীবনের বোধ-অনুভূতি-কষ্টগুলো উপলব্ধি করি এবং তা কোনো কাগজে লিখে রাখি নিজেরই প্রয়োজনে। বলুন এজন্য কি আমাকে কবি বলা যায়? আমি কবি হতে চাই না। আমি তাদের একজন বন্ধু হতে চাই।’ আসলে আমৃত্যু নিজের এই কথাগুলোর মতোই সমাজ সচেতন এক শক্তিমান মানুষ ছিলেন নেরুদা। তার সময়কার পলায়নপর মানসিকতার অজস্র বুদ্বিজীবী আর সাহিত্যিকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গর্ব করার মতো এক রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতীকও। আর এসব কিছুর সাথে তার লেখনীর শক্তিই তাকে করে তুলেছিল অনন্য। এক জীবনে সাহিত্যের নোবেল থেকে শুরু করে পেয়েছিলেন বহু সম্মাননাও। যদিও আর সবকিছুকে ছাপিয়ে গণমানুষের ভালোবাসা আর বোদ্ধাদের চোখে বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবির অভিধাই তাকে আলোকিত করেছিল সবচাইতে বেশি।
১৯৪৫ সালে খনি শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের প্রতিবাদ করায় চিলি সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন নেরুদা। ১৯৪৭ থেকে ’৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। ১৯৪৮ সালেপ্রেসিডেন্ট প্রার্থী গাব্রিয়েল গনজালেজ ভিদেলা সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। যার ফলে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন নেরুদা। চলে যান ইউরোপে। ১৯৫০ সালে ভারতে এসেছিলেন। আর ১৯৫২ সালে ফিরে যান চিলিতে। এরই মাঝে ১৯৫৩ সালে স্তালিন পুরস্কারে ভূষিত হন নেরুদা। ১৯৬৯ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি নেরুদাকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য মনোনীত করে। পরে সম্মিলিত বামফ্রন্ট সালভাদোর আলেন্দেকে সর্বসম্মত প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করলে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন নেরুদা। ১৯৭০ সালে আলেন্দে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়। আলেন্দে নেরুদাকে ফ্রান্সে চিলির রাষ্ট্রদূত করে পাঠান। ১৯৭২ সাল অর্থাৎ মৃত্যুর আগের বছর পর্যন্ত এই দায়িত্বই পালন করেন নেরুদা। এরই মাঝে কাব্যচর্চায় অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭১ সালে অর্জন করেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কারও। আর ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সান্তিয়াগোর সান্তা মারিয়া ক্লিনিকে মারা যান এই মানবতাকামী কবি।

0 comments:

Post a Comment