Breaking News
Loading...
Wednesday, July 28, 2010

বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার মাছিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৫ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি এলএলবি ডিগ্রিও লাভ করেন।
আবদুল মান্নান ভূঁইয়া কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং এ কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)’র সদস্য নির্বাচিত হন।
ছাত্র জীবন শেষ করার পর মান্নান ভূঁইয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ-ভাসানী) যোগ দেন। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। মাঝে কিছু দিন তিনি মনোহরদী কলেজ ও শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মান্নান ভূঁইয়া নরসিংদীর শিবপুরে অবস্থান করেন এবং নরসিংদী, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাবো, রায়পুরা অঞ্চলে বহু লোককে ট্রেনিং দিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মান্নান ভূঁইয়া এ এলাকায় পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া কৃষক সমিতির অন্যতম সংগঠক নিযুক্ত হন।
পরবর্তীতে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) গঠনে মান্নান ভূঁইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং প্রথমে ইউপিপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৮০ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর থেকে মান্নান ভূঁইয়া সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের পতন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী-৩ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন।
মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। একই বছর ১৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর পুনরায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯৬ সালের ২৬ জুন বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর এই পদে ছিলেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপির মহাসচিব ও দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
তার স্ত্রী অধ্যাপক মরিয়ম বেগম ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। মান্নান ভূঁইয়ার দুই পুত্র হচ্ছেন ভূঁইয়া অনিন্দ মোহায়মেন ও ভূঁইয়া নন্দিত নাহিয়ান।
ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গত ৩১ মে ২০১০ সনে মান্নান ভূঁইয়া সিঙ্গাপুর যান। সেখানে তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তাঁর দেহে মোট আটটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। সর্বশেষ কেমোথেরাপি দেওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলেন না তিনি। পরে তাঁকে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন দেওয়া শুরু হয়। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে দেশে এনে গত ৭ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল। সোমবার রাতে তাঁর অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে।
তিনি ২৮ তারিখ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ২ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।  চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুর সংবাদে রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই গভীর রাতে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান।  মরহুম মান্নান ভূঁইয়াকে দেখতে রাতেই জাসদের সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী জেড এ খান প্রমুখ হাসপাতালে যান।
মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে মান্নান ভূঁইয়ার মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে নিয়ে রাখা হয়। জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত মরদেহ হিমঘর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বুধবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে গুলশানের বাসায় নেওয়া হয়। এ সময় সেখানে সৃষ্টি হয় এক মর্মস্পর্শী অবস্থার।
মরহুমের মরদেহ বাসার নিচতলায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। খোলা হয় শোক বই। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, বিএনপি নেতা মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মুয়ীদ চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।
পরে মরদেহ সকাল ১১টায় নেওয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম নামাজে জানাজার জন্য। জানাজা শেষে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার আবদুল হামিদের পক্ষে চিফ হুইপ আবদুস শহীদ কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা শেষ শ্রদ্ধা জানান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংসদ, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানাজায় অংশ নেন। উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। আমরা একজন বিচক্ষণ রাজনীতিককে হারিয়েছি। তিনি ছিলেন ভালো মানুষ। সংসদের পক্ষ থেকে তাঁর আত্মার মারগফিরাত কামনা করছি।'
পরে দুপুর ১২টার দিকে বায়তুল মোকাররমে পৌঁছায় মান্নান ভূঁইয়ার মরদেহ। সেখানে বাদ জোহর মরহুমের দ্বিতীয় জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষ শরিক হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস, এ কিউ এম বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি নেতা আমিনুল হক, শামসুজ্জামান দুদু, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগের আবদুল মতিন খসরু, সিপিবির সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি সদরুল আমিনসহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকরা জানাজায় অংশ নেন। পরে নেতারা সারিবদ্ধভাবে মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
জানাজা শেষে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মান্নান ভুইয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। ইতিহাস এবং দেশের মানুষই তাঁর রাজনৈতিক অবদানের মূল্যায়ন করবে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মান্নান ভূঁইয়ার মরদেহবাহী গাড়িটি শিবপুরে যায়। এ সময় রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নারী-পুরুষ কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রথমে মাছিমপুরের গ্রামের বাড়িতে মরদেহ নেওয়া হয়। মানুষের ভিড় ঠেকাতে না পেরে মরদেহ এনে রাখা হয় শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে এসে এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙে পড়ে।
বাদ আসর মান্নান ভূঁইয়ার স্মৃতিবিজড়িত শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পরপর দুবার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন, সাবেক পরারাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক, বিএনপির কেন্দ্রীয় পরিষদের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন, নরসিংদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহী, শিবপুর উপজেলার চেয়ারম্যান ফটিক মাস্টার, পৌর মেয়র লোকমান হোসেনসহ প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
এরপর সবার ভালোবাসা নিয়ে শহীদ আসাদ কলেজসংলগ্ন ধানুয়া গ্রামের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন মান্নান ভূইয়া।

0 comments:

Post a Comment