বিগত শতকে এ দেশে যে ক'জন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানচর্চার মানচিত্রে স্থান উজ্জ্বল করেছিলেন মেঘনাদ সাহা তাদের অন্যতম। শুধু অন্যতম নয় বরং অনন্য। তার কারণ তিনি বিজ্ঞানচর্চার মধ্যেই তার কর্মজীবন সীমিত রাখেননি। তিনি বিজ্ঞানকে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করে সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
সে সময় বিদেশি শাসনের চাপে দেশ যখন অজ্ঞতা কুসংস্কার ও দরিদ্রে মৃতপ্রায় সেই যুগে ঢাকা জেলার অন্তর্গত (বর্তমান গাজীপুর জেলা) কালিয়াকৈর থানার অধীনস্থ সেওড়াতলী গ্রামে ৬ অক্টোবর ১৮৯৩ সালে মেঘনাদের জন্ম হয়েছিল।
পিতা জগন্নাথ সাহা ও মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান তিনি। তার নামকরণ নিয়ে কোনো উৎসব হলো না, কোনো স্কুল ছিল না। মোটামুটি গ্রাম্য পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে সাধারণ শিক্ষা নিয়ে খুশি থাকতে হতো। পণ্ডিত মেঘনাদের মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দিয়ে জগন্নাথ সাহাকে বললেন, আপনার ছেলেকে পড়াবার চেষ্টা করুন ওর মেধা ভালো, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। জগন্নাথ সাহা সে কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, ওকে দোকানের কাজ শিখাতে হবে। কিন্তু মেঘনাদের এ কাজ পছন্দ নয়। বড় ভাই বাবাকে বুঝিয়ে ৭ মাইল দূরে শিসুলিয়া মডেল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। প্রতিদিন তাকে ১৪ মাইল রাস্তা হাঁটতে হতো। প্রতিদিন হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় বলে শিমুলিয়ার বাসিন্দা ড. অনন্ত দাস মহাশয়ের শরণাপন্ন হলো। শিক্ষার জন্য তাকে বহুকষ্ট করতে হয়েছে।
শিমুলিয়া মডেল স্কুল থেকে পাস করে বৃত্তি পেয়ে মেঘনাদ ঢাকা কলেজিয়েট সরকারি স্কুলে ভর্তি হলেন এবং আরমানীটোলার এক বাসায় ছোট ছেলেদের পড়াশোনার পরিবর্তে তার থাকার ব্যবস্থা হলো। ১৯০৫ সালে এই সময়টা খুব বিক্ষোভের সময়। তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলছে। এ সময় তাদের স্কুল পরিদর্শনের জন্য গভর্নর বাম্পফিল্ড ফুলার এসেছিলেন। তার প্রতি প্রতিবাদ জানাতে ছেলেদের সঙ্গে মেঘনাদ খালি পায়ে স্কুলে এসেছিলেন। এ অপরাধে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং বৃত্তির টাকাটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন সময় বেসরকারি কেএল জুবিলী স্কুল কমিটি এগিয়ে এলেন। মেঘনাদকে বিনা বেতনে ভর্তি করে দিলেন এবং বৈষ্য সাহা সমাজ থেকে তাকে বৃত্তির টাকা সাহায্য করে দিলেন। সে বছর ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মেঘনাদ সব বিভাগে সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এরপর ১৯০৯ সালে ঢাকা কলেজে সাইন্স নিয়ে ভর্তি হন। এ সময় নিজ উদ্যোগে অধ্যাপক নগেন্দ্র নাথের কাছে জার্মান ভাষা শিখেন। ১৯১১ খ্রি. মেঘনাদ গণিতে অনার্স নিয়ে বিএসসিতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। এরপর থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গণিতে বিএসসিতে অনার্স ও ফলিত গণিতে এমএসসি পরীক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
সে যুগে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তরুণ মানসে সে যে অশ্রদ্ধা জাগ্রত ছিল, প্রতিভাবান মেঘনাদও সেই মানসিকতার শরিক ছিলেন।
এসময় সাহা তার গবেষণাকর্ম শুরু করেন। মেঘনাদ সাহার প্রথম গবেষণা ছিল 'অন মাস্কতারলস স্ট্রেসেস'। এটি ১৯১৭ সালে ফিলোসফিক্যাল মেগাজিনে প্রকাশিত হয়। এরপর একের পর এক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯১৮ সালে আলোর চাপ বিষয়ে সাহা তার ডিএসসি থিসিস তৈরি করেন এবং পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড ক্লাসিফিকেশন অব স্টেলার স্পেক্টা বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি রায়চাঁদ, প্রেমচাঁদ বৃত্তি ও অরিজিন অব লাইন্স ইন স্টেলার স্পেক্টা বিষয়ে গবেষণার জন্য গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯২০ সালে তাপ আয়নন তত্ত্ব দ্বাদশতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, এরপর ইংল্যান্ডে ১৯২০ সালে সাহা ফেলো অব রয়েল সোসাইটি নির্বাচিত হন। এরপর ড. সাহার নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
উনিশ শতকে বিজ্ঞানের যে সামান্য সূত্রপাত ঘটেছিল তা যে এখন বিরাট আকারে পরিণত হয়েছে তার মূলে যাদের অবদান ড. সাহা তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ড. মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। এই পদে থাকাকালীন তিনি সাইক্লোটন গবেষণার সূত্রপাত করেন। সাইক্লোটনকে কেন্দ্র করে গড়েছিলেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। সাহা ইনস্টিটিউট ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অব সায়েন্সের তিনি আজীবন ডিরেক্টর ছিলেন।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিলি্লর প্ল্যানিং অফিসে যাওয়ার পথে স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়। জ্ঞান অন্বেষণে ও কর্তব্য সাধনে অবিচল নিষ্ঠা, অদম্য অধ্যবসায় এবং বৈজ্ঞানিক অবদানে সর্বপ্রকার সচেষ্ট হওয়া এ ছিল তার জীবনের আদর্শ। অধ্যাপক সাহার ১১৭তম জন্মদিবসে তার জীবনাদর্শে যদি আমরা কিছুটাও উদ্বুদ্ধ হতে পারি তবেই তার স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।
ড. সাহার আবিষ্কার
আগুনের শিখার পরিবাহিতা বিস্ফোরক বিজ্ঞান, নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, কণাত্বরণের আয়নন উৎস, থার্মোনিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর প্রভৃতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় সাহার আয়ননতত্ত্ব অথবা কোনো না কোনো পরিবর্তিত রূপের বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তাই সাহার আয়ননতত্ত্ব গত শতকের এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বলা যায়।
রথীন্দ্রনাথ সাহা
মেঘনাদ সাহা
Info Post
0 comments:
Post a Comment