Breaking News
Loading...
Thursday, September 30, 2010

নাট্যকার সাঈদ আহমদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে, ওয়াশিংটন এরিনা স্টেজের নাট্যশালার দর্শক আসনের একটি সারি তার নামে অঙ্কিত করা হয়েছে। যা আর কোনো বাঙালি নাট্যকারকে নিয়ে হয় নি। ফরাসি সরকারের লিজন দ্য অনার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে, চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক পান ২০০৮ সালে, আবদুল জব্বার খান স্বর্ণপদক পেয়েছেন ১৯৯৫ সালে। নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি ১৯৯৭ সালে, লোকনাট্য দল পদক ১৯৯৬ সালে এবং মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন ২০১০ সালে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বাংলাদেশের সুর স্রষ্টারা' (২০০৩), 'জীবনের সাতরং' (২০০৭) ও 'ঢাকা আমার ঢাকা' (২০১০)।



বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার ও সংগীতকার সাঈদ আহমদ পুরান ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১ জানুয়ারি ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে উচ্চতর পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে। পেশাগত জীবনে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা।

ছেলেবেলায় তার ইচ্ছা ছিল উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী হওয়ার। পরে আধুনিকসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় 'সাঈদ আহমদ ও সম্প্রদায়' নাম দিয়ে একটি দল গঠন করেন। নাজিম উদ্দিন রোড ও দেওয়ানবাজার রেডিও স্টেশন থেকে নিয়মিত অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করত এই সম্প্রদায়। অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন সাঈদ আহমেদ, স্ক্রিপ্ট লিখতেন প্রধান কবি শামসুর রাহমান। ১৯৫৪ সালে সাঈদ আহমদ লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়তে যান। সেখানে তিনি পড়ালেখার ফাঁকে ওয়েস্টান মিউজিক শিক্ষা শুরু করেন। বিবিসির খণ্ডকালীন হিসেবে সেতার ও অর্কেস্ট্রা বাজাতেন উর্দু সার্ভিস, বাংলা সার্ভিস, ওয়েস্ট বেঙ্গল শ্রীলংকা সার্ভিসে। এছাড়া সেতার বাজিয়েছেন অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে।

১৯৫৬ সালে সাঈদ আহমদ লাহোরে চলে আসেন সরকারি চাকরি সূত্রে। তারপর 'অ্যাবসার্ড' ধারার নাটক লিখতে শুরু করেন। পঞ্চাশ দশকে ইউরোপে এই নাট্যচর্চার প্রকাশ ঘটে। তিনি বাংলা 'থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড' নাট্যধারার পুরোধা পুরুষ। ১৯৬১-৬২ সালে এক বছর ধরে তিনি লেখেন 'ঞযব ঞযরহম' বাংলায় 'কালবেলা', ১৯৬২-৬৪ রচনা করেন 'ঞযব গরষবঢ়ড়ংঃ', ১৯৬৪-৬৬ তে রচনা করেন 'ঝঁৎারাধষ' বাংলায় 'তৃষ্ণায়'। এরপর দুটি বাংলা নাটক রচনা করেন ১৯৭৪ সালে 'একদিন প্রতিদিন' ও ১৯৮২ সালে 'শেষ নবাব'। এছাড়া তার নাটক অনূদিত হয়েছে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায়। তিনি চিত্রকলার সমালোচক হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

নাট্যকার, চিত্র-সমালোচক ও সংস্কৃতিবেত্তা হিসেবে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশে লেকচার দিয়েছেন তার মধ্যে আছে নেপাল, ইউএসএ, হংকং, সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব জার্মানি, ব্রাজিল, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, নরওয়ে, চীন, ভারত ও হল্যান্ডসহ পৃথিবীর নানা দেশ। বাংলাদেশের নাটককে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দানে তার উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। তিনি পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও পারফমিং আর্টস বিভাগে বক্তৃতা ও সেমিনার পেপার পড়েছেন।

সাঈদ আহমদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'বিশ্ব নাটক' অনুষ্ঠান শুরু করেন ১৯৮২ সালে। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বিশ্বের খ্যাতিমান নাট্যকারদের জীবনী উপস্থাপন করতেন। মাত্র চারটি নাটক প্রচার হওয়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু তিনি বিটিভির মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হয়। ১৯৮৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আবার বিটিভিতে 'বিশ্ব নাটক' বিষয়ক অনুষ্ঠান করেন। প্রতি মাসে ১২টি করে নাটকসহ মোট ৭১টি নাটক প্রচার হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ও উল্লেখযোগ্য নাট্যকারদের নাটক প্রচার করা হতো। মূলত আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোর নাটক নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন তিনি। বিশ্বের খ্যাতিমান নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী সমালোচকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল।

১৯৭৬ সালের দিকে আইএমএফ-এ কাজ করার সময় সাঈদ আহমদের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির গেস্ট লেকচারার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। দেশের বিশিষ্ট নাট্যকার হিসেবে সাঈদ আহমদ পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ওয়াশিংটন এরিনা স্টেজের নাট্যশালার দর্শকাসনের একটি সারি তার নামে অঙ্কিত করা হয়েছে। যা আর কোন বাঙালি নাট্যকারকে নিয়ে হয় নি। ফরাসি সরকারের লিজন দ্য অনার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে, চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক পান ২০০৮ সালে, আবদুল জব্বার খান স্বর্ণপদক পেয়েছেন ১৯৯৫ সালে। নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি ১৯৯৭ সালে, লোকনাট্য দল পদক ১৯৯৬ সালে এবং মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন ২০১০ সালে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বাংলাদেশের সুর স্রষ্টারা' (২০০৩), 'জীবনের সাতরং' (২০০৭) ও 'ঢাকা আমার ঢাকা' (২০১০)।

সাঈদ আহমদ একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন। দাদা মির্জা মো. হায়াৎ খান গান বাজনায় শৌখিন ছিলেন। বাবা মির্জা এফ মোহাম্মদ খান হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। মা জামিলা খাতুন হামদ ও নাত গাইতেন। তার বড় ভাই আবু নাসির আহমদ সলিমুল্লাহ হলের মেধাবী ছাত্র, অভিনয় ও খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তারপর নাজির আহমদ ছিলেন বিবিসির প্রথম বাঙালি মুসলিম ঘোষক ও এফডিসির প্রতিষ্ঠাতা। আরেক ভাই শিল্পী হামিদুর রহমান জাতীয় শহীদ মিনারের স্থপতি, স্ত্রী পারভীন আহমদ গবেষক ও সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সাঈদ আহমদের উদ্যোগে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পুরস্কার ও বৃত্তি। তার পারিবারিক পাঠাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বই ও সিডি। তিনি ২১ জানুয়ারি ২০১০ প্রয়াত হন। এদেশের প্রতিটি নাট্যকর্মী সাঈদ আহমদের কাছে ঋণী। আমৃত্যু তিনি থিয়েটার ও বাংলা নাটকের উন্নয়নে কাজ করেছেন। বাংলা নাটকে অনন্য অবদানের জন্য তিনি চির স্মরণীয় থাকবেন।
-শেখ মেহেদী হাসান 

0 comments:

Post a Comment