তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, বাংলার কৃষকের রানীমা ইলা মিত্র। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তারপরও থেমে থাকেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়েছেন এই মহীয়সী নারী। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি সাঁওতাল বেশ ধারণ করে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে ইলা মিত্র ধরা পড়েন। তারপর শুরু হয় নির্যাতন। একজন নারী হিসেবে তাকে কোনো সম্মান দেওয়া হয়নি। বরং হিন্দু কমিউনিস্ট নারী হওয়ায় তার ওপর অত্যাচারের মাত্রা ছিল বেশি। অনাহারে রাখা, শরীরের লাজুক অংশে বুটের আঘাত, পায়ের গোড়ালিতে পেরেক ঢুকিয়ে, শরীরে সিদ্ধ ডিমের স্যাঁকা দেওয়ার মতো অত্যাচার চালানো হয়। তবুও তার স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি শোষক শ্রেণী। এই সংগ্রামী শত অত্যাচারের মধ্যেও অনড় থেকেছিলেন।
ইলা মিত্র ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালি মেয়ে, যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন, যা যুদ্ধের কারণে বাতিল হয়ে যায়। কলকাতায় বেথুন কলেজে থাকাকালীন নারী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এভাবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দেশবাসী কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর কলকাতা ছেড়ে চলে যান। সেখানে জমিদার পরিবারের নিয়মানুযায়ী অন্দরমহলেই থাকতেন তিনি। এক সময় গ্রামবাসীর প্রস্তাবে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও দেখাশুনা করতে গিয়ে তিনি অন্দরমহল থেকে বের হয়ে বৃহত্তর সমাজসেবার নিজেকে নিয়োজিত করেন। স্বামীর মুখে তিনি কৃষকদের বঞ্চনা শোষণের কাহিনী শুনতেন। পরিবারের ঐতিহ্য ও মোহ ত্যাগ করে কৃষকের পাশে দাঁড়ানো স্বামীর আদর্শে নিজেকে যুক্ত করেন।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চল তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র। ওই সময় জমিদারি ও গোত্রধারী প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা কৃষকদের দাসের মতো ব্যবহার করত। '৪২ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। তখন কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এরকম অস্থিরতায় মরিয়া হয়ে উঠে কৃষক। 'তিন ভাগের দুই ভাগ ফসল' কৃষক শ্রেণীর এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময় নাচালের চণ্ডীপুরে এক সাঁওতাল নেতার বাড়িতে আত্মগোপন করেন ইলা ও রমেন্দ্র মিত্র। সেখানেই ঝিমিয়েপড়া আন্দোলনকে চাঙ্গা করে তোলেন_ তখনই তেভাগা আন্দোলন বাস্তব রূপ পায়। কৃষকদের প্রতিরোধের মুখে আপাতভাবে তেভাগা কার্যকর করা হলে ভূমি মালিকরা থেমে থাকেননি। তখন সরকারের পুলিশ বাহিনী বিভিন্নভাবে কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালাতে থাকে। অত্যাচার চলাকালীন এক পর্যায়ে গ্রামের কৃষকরা পুলিশ কর্মকর্তা ও ৫ জন কনস্টেবলকে হত্যা করেন। তখন দায়ের করা হয় পুলিশ হত্যা মামলা। 'নাচোল হত্যা মামলার'র প্রধান আসামির মধ্যে ইলা মিত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার ওপর চলে অমানুষিক অত্যাচার।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের নির্দেশে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। সুস্থ হওয়ার পর স্কুলে শিক্ষকতাসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজ করেন। অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবাই করতে পারে সে নারীই হোক বা পুরুষ হোক, সে জন্য দরকার সাহস ও দৃঢ় মনোবল। মহীয়সী ইলা মিত্রের মধ্যে তা ছিল। শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে শোষিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন আবার শিক্ষকতা করে অগণিত শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। এই কিংবদন্তি নেত্রী ৭৭ বছর বয়সে ২০০২ সালে প্রয়াত হন। কমরেড ইলা মিত্র বাংলার কৃষকের রানীমা হয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকার, সবার মাঝে।
---আইরিন সুলতানা---
ইলা মিত্র
Info Post
0 comments:
Post a Comment