Breaking News
Loading...
Friday, March 18, 2011

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মূলত তিনি এমন একজন কবি, যিনি তার মৃতু্যর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন।

১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের জেলা শহর বরিশালে জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণা নিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৯৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বরিশালে আবাস গড়েন। সর্বানন্দ দাসগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন। পরে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি তার মানবহিতৈষী কাজের জন্যে সমাদৃত ছিলেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন কবি। তার সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে) আজও শিশুশ্রেণীর পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলে বাড়িতে মায়ের কাছেই মিলুর (জীবনানন্দের ডাক নাম) বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন। লাজুক স্বভাবের হলেও তার খেলাধুলা, ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল। ছেলেবেলায় একবার কঠিন অসুখে পড়েন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ হাসির গানের কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্মৌ, আগ্রা, দিলস্নী প্রভৃতি জায়গা ভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। ইস্কুলে থাকাকালীন সময়েই তার বাংলা ও ইংরেজিতে রচনার সূচনা হয়, এ ছাড়াও ছবি আঁকার দিকেও তার ঝোঁক ছিল। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু'বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান এবং অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশে বরিশাল ত্যাগ করেন। অধ্যাপনার কাজেই তার কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি। এমএ পাসের পর কলকাতায় কলেজের বোর্ডিং-এ থাকার প্রয়োজন হলে তিনি আইন পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী। সম্ভবতঃ মা কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তার লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত কলেস্নাল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬ খৃ.) ফাল্গ-ন সংখ্যায় তার নীলিমা শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার অন্নপ্রাশন হয়। জীবদ্দশায় তার ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তার প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ধূসর পাণ্ডুলিপি'তে তার স্বকীয়তা ফুটে ওঠে। কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোড়ঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে, তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা, যা তার মৃতু্যর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ষাট-পঁয়ষট্টিরও বেশি খাতায় 'লটেরেরী নোটস' লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও (২০০৯) প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃতু্যর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছেন, যার একটিও তিনি জীবদ্দশায়?প্রকাশ করেননি। তার জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকালে অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তার প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তী কালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত।

১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। এ সময় স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ কাছে দেখা যায়। তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।আবদুল মান্নান সৈয়দ সহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন হয় আত্মহত্যাস্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ।

উৎসঃ ইত্তেফাক, হাসান হাফিজের লেখাসংবাদে প্রকাশিত জীবনানন্দের খেরোপাতা

0 comments:

Post a Comment