Breaking News
Loading...
Wednesday, September 7, 2011

ষোড়শ শতকের এক ভারতীয় সন্ত। যিনি মনে করতেন, মানবজীবনের একমাত্র মোক্ষ ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ । সে জন্য ঐকান্তিক সাধনার প্রয়োজন। তবে আত্বকেন্দ্রিক মানুষ কখনও সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। আত্বকেন্দ্রিক মানুষ মায়ার ঘোরে পড়ে ক্ষণিকের সুখলাভ করে মাত্র ...নানক আরও বলেছিলেন যে ...উচ্চতম সত্যকে জানতে হবে ঠিকই, তবে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সত্যপূর্ন জীবনযাপন করা ...

নানক এর জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষে ...

তালভানদি গ্রামটি ছিল বর্তমান কালের পাকিস্থানের লাহোরের কাছে। এখন অবশ্য জায়গাটির নাম নানকানা সাহিব। সেই তালভানদি গ্রামেই বাস করতেন ত্রিপ্তা দেবী নামে এক নারী। ভারি শ্রীময়ী দেখতে ছিল ত্রিপ্তা । ঢলোঢলো। শ্যামলা। গাঁয়ের মেয়েরা তাঁকে ঠোঁট টিপে হাসত। আর বলত, দেখিস, তোর কোলআলো করে একদিন এক শিশুর জন্ম হবে।
তাই হল কিন্তু।
১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ। এপ্রিল মাস, ১৫ তারিখ।
ত্রিপ্তা দেবীর ঘর আলো করে জন্ম হল এক শিশুর।
যে শিশুটি বড় হয়ে জাতপাতের বিরুদ্ধে প্রবল রুখে দাঁড়িয়েছিল।
শিশুটির বাবার নাম ছিল কল্যান দাশ বেদী। কল্যান দাশ বেদী ছিলেন জাতে ক্ষত্রিয়, তবে পেশায় পাটোয়ারি। পাটোয়ারি মানে কিন্তু হিসাব রক্ষক, ঠিক পাটচাষি নয়।
তালভানদি গাঁয়ের জমিদার ছিলেন মুসলমান। তখন তো পাঞ্জাবে মুসলিম শাসন চলছে। তবে মুগলরা তখনও দিল্লীতে ঠিক অধিষ্ঠিত হয় নি। (এখানে আরও বলে রাখি যে পাটোয়ারি উপাধী দেখে অনেকেই মনে করেন যে পাটোয়ারিরা পাটচাষি কিংবা পাটজাত সামগ্রীর ব্যবসা করেন। আসলে তা নয়। পাটোয়ারিরা ছিল হিসাবরক্ষক। মুগল আমলে পদটির সৃষ্টি। )
তো, শিশুটির নাম রাখা হল নানক। মায়ের ইচ্ছেতেই কি? কে বলতে পারে?
শিশুটি যথাসময়ে বড় হল। বালক হল। বালক নানক ছিল অন্যরকম। কেমন, চুপচাপ, লাজুক,অল্পভাষী, গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলে না। একা একা থাকে। আর কী যেন ভাবে। আসলে তেমনই তো হওয়ার কথা। কেননা সে বড় হয়ে বলবে ..."Realisation of Truth is higher than all else. Higher still is truthful living"
নানকের এক বোন ছিল। নাম, নানাকি। নানক বোনকে বড্ড ভালবাসত। তবে মুখে বলত না। বোন যা আবদার করত তা সে দৌড়ে এনে দিত। এভাবেই নানক ছিল অন্য রকম।
তারপর একদিন কিশোর বয়েসে পৌঁছল নানক।
কাম নিয়ে কেমন এক উদগ্র কৌতূহল ছিল তার আশৈশব। কাম এড়িয়ে প্রেমের আরাধনা করতে চায় কিশোর। পারে না। পিছলে যায়। মনে মনে গান বাঁধল-

করি মানা কাম ছাড়ে না মদনে
আমি প্রেমরসিক হব কেমনে?

শেষমেশ বিয়ে করল নানক। দুটি সন্তানও হল তার বউটির। ভালো কথা। তো এখন সংসার চলবে কি ভাবে? বাবা তো তেমন কিছু রেখে যাননি। নানকের টনক নড়ল।
তো, সেই সময় পাঞ্জাবের সুলতানপুর শহরের প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন দৌলত খান লোদী। তারই শরনাপন্ন হলেন নানক। যাহোক। দৌলত খান লোদী অধীনে কোনওমতে পাটোয়ারির চাকরি জুটল একটা।
পাটোয়ারির চাকরি করছে নানক। মন বসে না। হিসেবে গড়মিল হয়ে যায়। যার অন্তরে অসীমের প্রেরনা- তার ওই সামান্য হিসেবনিকেশে কী হয়।
বয়স নানকের যখন তিরিশ ... ঠিক তখনই ভিতরের ডাক শুনতে পেল সে।

কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।

দুর ছাই! চাকরি করে কে! আমি অনন্তের পাখি।
নানক দৌলত খান লোদীর কাচারি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।
কোথায়?
পথে।
কী আশ্চর্য! ঠিক সেই সময়ই মারদানার সঙ্গে পরিচয় হল। পথে। মারদানা ছিলেন মুসলিম সুফি। দীর্ঘদেহী ফরসা কালো পাঞ্জাবি পরা উদার মনের এক মানুষ মারদানা। কাছে গেলে আতরের তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়। ঝোলার মধ্যে গোটা দুই জালালি কবুতর। শুকনো কিসমিস আর ফারসি ভাষায় লেখা হাল্লাজের পুথি।
এই রকম একটা জ্ঞানী ছন্নছাড়া সংসারত্যাগী মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে ভারি আনন্দ হল নানকের।
তো, নানকের মনে তখন বোধি লাভের প্রচন্ড আশা। বোধি মানে- জীবনজগৎ সম্বন্ধে একটি স্বচ্ছ ধারনায় পৌঁছনো। বোধি লাভ করতে হলে তীর্থে যেতে হয়। কাজেই, মারদানার সঙ্গেই ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব তীর্থগুলি দর্শন করল নানক। বৃন্দাবনেও গেল, আজমিরও গেল। আসলে, দুজনের মনেরই ভীষন মিল হয়েছিল। দু’জনই জাতপাতের তীব্র বিরোধী। মারদানা আবার বাদশাহিবিরোধী। প্রায়ই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,“বুঝলে নানক, এই যে মুসলিম বাদশাদের জাঁকজমক দেখ। নিমকহারামরা সব যাকাত না দিয়ে হেরেম তৈরি করছে। ওদের কি বেহেস্তে যায়গা হবে বল?”
নানক মাথা নাড়ে। যাকাত না দেওয়া তো অন্যায়। অন্যায়কারীরা বেহেস্তে যায় কি করে।
তো, দু’জনে তীর্থে তীর্থে ঘুরছেন। সে সময়ই মারদানার মুখে নানক শুনল পারস্যের ফরিদউদ্দীন আত্তারের কথা; বাগদাদের মনসুর হাল্লাজের কথা; কোনিয়ার জালালউদ্দীন রুমীর কথা।
নানক উত্তেজনা বোধ করে। অনুপ্রানিত হয়। কী এক স্বপ্ন দেখে সে।
১৫২০ দিকের কথা। পাঞ্জাবের কাছে ছিল কর্তারপুর নামে এক গ্রাম । একেবারে রবি নদীর পাড়ে। বহুপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে সেই গ্রামেই এসে থিতু হলেন নানক। বয়স হয়েছে। শরীর আর চলে না।
(নানক তাঁর জন্মগ্রামে ফিরলেন না কেন? তাঁর বউ বাচ্চারই-বা কি হল? এই প্রশ্ন দুটি আমাকে ভাবায়।)
যাহোক। আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ভীষন নাম ছড়াল নানকের। উপরোন্ত, লালনের মতই জাতপাত ঘৃনা করতেন নানক। কাজেই বহু লাঞ্ছিত নরনারী এসে জড়ো হল কর্তারপুর গ্রামে। নানকের শিষ্যত্ব বরণ করল তারা। নানক শিষ্যদের বলতেন “শিখ”। শিখ মানে শেখ, জাতপাত যে ভালো না, তাই আমার কাছে এসে শেখ।
শিখ শব্দটি অবশ্য উদ্ভুত হয়েছে সংস্কৃত শিক্ষা শব্দটি থেকে। শব্দটির মূলগত অর্থ- শিক্ষা বা শিষ্য।
শিখধর্মটি বর্তমানে বিশ্বের ৫ম সাংগঠনিক ধর্ম। কর্তারপুর গ্রামে যে ধর্মটির সূত্রপাত। নানক ছাড়াও আরও ৯ জন গুরু শিখধর্মটি প্রতিষ্ঠিত করেছে।



১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে নানকের দেহখাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল অনন্তের সেই পাখিটি। যে পাখি অনন্ত থেকেই উড়ে এসেছিল একদিন।
নানকের প্রিয় শিষ্য ছিলেন অঙ্গদ। নানকের তিরোধানের পর ইনিই নব্য ধর্মস¤প্রদায়টির হাল ধরলেন। তারপর ক্রমে ক্রমে নানকের উপদেশের কর্তারপুর গ্রামে গড়ে উঠেছিল এমন এক ধর্মীয় গোষ্ঠী-যারা কেবল পরবর্তীকালে পরম পরাক্রমশালী মুগলদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়নি, কুড়ি শতকে হয়ে উঠেছিল আধুনিক ভারত সরকারের এক প্রবল প্রতিপক্ষ।
কিন্তু, কি ছিল নানকের শিক্ষা?



নানক।

নানকের জীবদ্দশায় উত্তর ভারতের হিন্দু সন্তরা মরমী কবিদের মতো একেশ্বরবাদের শিক্ষা প্রচার করতেন। তারা সামাজিক সাম্য ও সৎগুরুর প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা বলতেন। নানকের ওপর এই মরমী কবিদের প্রভাব পড়েছিল। নানক সন্তদের মতোই প্রাত্যহিক জীবনের দৃশ্যাবলীর আড়াল ভেদ করে ‘সহজ’ অর্জন করতে চেয়েছেন। সহজ কি? সহজ অর্থ - ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। নানক এর মতে ঈশ্বর যুগপৎ অজ্ঞেয় এবং মানবসত্ত্বায় অস্তিত্বশীল; কঠোর বৈরাগ্য কিংবা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা দ্বারা ঈশ্বরলাভ সম্ভব নয় ... এর জন্য প্রয়োজন সৎগুরুর নির্দেশে ঐকান্তিক সাধনা। আত্বকেন্দ্রিক মানুষ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারে না, তারা মানুষ মায়ার ঘোরে পড়ে ক্ষণিকের সুখলাভ করে মাত্র । স্বর্গীয় নামের জপ আর আধ্যাত্মিক অন্তঃদর্শন (স্পিরিচুয়াল ইন্ট্রোস্পেকশন) পারে মানুষের এই আত্মকেন্দ্রিকতা দূর করতে। এভাবে মহাবিশ্বের শব্দ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যায়। যে শব্দে ভক্তসহ সবই হল রূপ (ফর্ম)। এই সত্যে ক্রমাগত ধ্যান করে সবকিছুর ভিতরে এক ‘অনাহত’ শব্দ সম্বন্ধে ভক্ত সচেতন হয়ে ওঠে। এবং বিশৃঙ্খল সত্ত্বার বিরুদ্ধে ক্রমশ সংগ্রাম করে ভক্ত সহজ অর্জনের পথে এগিয়ে যায়।
প্রতিদিনের জীবনে বেঁচে থেকে ঐশ্বরিক উপলব্ধিই নানকশাহী পন্থা। নানক শিষ্যদের অতিরিক্ত সন্ন্যাস নিষেধ করতেন; প্রতিদিনের কাজকর্মের ভিতরেই আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রকাশ পেতে পারে। এ কারণে সংস্কৃত কিংবা আরবি ভাষায় নয়-সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় ধর্মের ব্যাখ্যা করতেন। নানক এর জনপ্রিয়তার এইই কারণ। নানক এর পরবর্তী ন’জন অনুসারী তো বটেই আজও বিশ্বজুড়ে অসংখ্য শিখ নানকের সুগভীর উপলব্ধি আপন জীবনের ব্রত করেছে।



আদি গ্রন্থ

নানকের শিক্ষা শিখদের পবিত্র গ্রন্থ আদিগ্রন্থে লেখা রয়েছে। ‘আদি গ্রন্থ’ শব্দ দুটি পাঞ্জাবি । এর অর্থ: প্রথম বই। আদিগ্রন্থের অন্য নাম- গুরু গ্রন্থ সাহিব। এতে ৬,০০০ প্রার্থনাসংগীত রয়েছে; সবই নানকসহ অন্যান্য শিখগুরুরা সাধুরা লিখেছেন। প্রার্থনাসংগীতগুলি রাগভিত্তিক। প্রথম এবং ৩য় গুরু নানক এবং অমর দাস (১৪৭৯-১৫৭৪) নিজের ধর্মগীতি সংকলন করে ও অন্যান্য আদিকবিদের গান অর্ন্তভূক্ত করেন।



অমৃতসর। মানচিত্র।

১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্জম গুরু অর্জন সিং আদিগ্রন্থে আরও গান অর্ন্তভূক্ত করেন এবং এভাবে আদিগ্রন্থের প্রথম সংস্করণটি সম্পূর্ন হয়। তিনি এটি অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে রাখেন।



অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির; শিখদের পবিত্র তীর্থ।



স্বর্ণমন্দিরে অভ্যন্তরে

১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের শেষ গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর পিতা গুরু তেগ বাহাদুরের ভক্তিসংগীত আদিগ্রন্থে অর্ন্তভূক্ত করে আদিগ্রন্থের সঙ্কলন সম্পন্ন করেন। গোবিন্দ সিং য়ের মৃত্যুর আগে তিনি গ্রন্থটিকে শিখদের ‘গুরু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যান। শিখরা আজ অবধি আদিগ্রন্থকে তাদের গুরু হিসেবে মান্য করে। শিখ প্রর্থনালয়ে (গুরুদোয়ারা) বইটির অনুলিপি রক্ষিত আছে।



গুরুদোয়ারা। শিখ-জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে আদিগ্রন্থ সকালে খোলা হয় ও রাত্রে মুড়িয়ে রাখা হয়। আদিগ্রন্থের গীত গাওয়া হয়। আদিগ্রন্থের সামনে জুতা খুলে যেতে হয়। আর মাথা ঢেকে রাখতে হয়। এটি পাঠকালে বাতাস করা হয়; যেন গ্রন্থটি জীবন্ত আর সম্মানিত ...



ঢাকার গুরুদোয়ারা।



শিখ। Sikh শব্দটি পাঞ্জাবি। এর অর্থ ছাত্র। বা শিষ্য। কার শিষ্য? গুরুর। গুরুমৎ ধর্ম। শিখ ধর্মে সৎগুরুর নির্দেশনার কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।

লিখেছেনঃ ইমন জুবায়ের

0 comments:

Post a Comment