মৌসুমীর জন্ম সংস্কৃতমনা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার মা শামীমা আখতার জামান নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। মায়ের অনুপ্রেরণায়ই গানের ভুবনে প্রবেশ করেন মৌসুমী। দেশীয় গস্ন্যামার জগতে প্রবেশের গল্প নিয়ে মৌসুমী বলেন, 'স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সবে মাত্র কলেজে উঠেছি। তখন আমরা কলাবাগানে থাকি। একই বাড়ির চার তলায় থাকতেন বিজ্ঞাপন নির্মাতা সাকিব লোহানীর ভাগি্ন। সাকিব লোহনী ছিলেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান, তার ভাগি্নর জন্মদিনের দাওয়াতে সাকিব লোহানী আমাকে দেনেখ। তখনই তার স্ত্রীর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনে কাজের অফার দেন। আমি তাকে পরিবারের অনুমতি জানার কথা বলে সময় নিই। তারপর পরিবারকে এ বিষয়ে জানালে কেউ এ বিষয়ে আমাকে উৎসাহিত করেনি। এইচ এস সি পাশের পর লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হলাম। এরই মধ্যে আবার বিজ্ঞাপনের অফার পেলাম। এবার সাহস করে বাবাকে বলার পর তিনি বললেন, বিএ পাশ করার পর তোমার যা ভাল লাগবে তুমি তাই করতে পারবে। কিন্তু মৌসুমী নাছোড়বান্দা, বাবাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাকিব লোহানীর অফিসে যোগাযোগ করে ছবি পাঠালেন। পরদিন তার ডাক পড়ল সেই অফিসে। মৌসুমীর কথায়, 'তারা ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সেখানে গেলাম। স্ক্রিন টেস্ট ও ফটো, ভিডিও গ্রাফিতে অংশ নিলাম। সবাই পছন্দ করলেন আমাকে। তিনটি বিজ্ঞাপনের কাজে চুক্তিবদ্ধ হলাম। আমার প্রথম বিজ্ঞাপনটি ছিল মেরিল স্কিন কেয়ার ক্রিমের।' প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে মৌসুমী বলেন, 'প্রথম যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম তখন বেশ নার্ভাস ছিলাম। এত বেশি নার্ভাস ছিলাম যে মেকআপ নেয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ফলে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেল। আবার মেকআপ নিলাম চলচ্চিত্রের মেকআপম্যান খলিল ভাইয়ের কাছ থেকে। তারপর বিজ্ঞাপনের কাজ করলাম। ওই সময় আনন্দ বিচিত্রার লাক্স ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠালাম। পাঠকের ভোটে সেরা সুন্দরী হলাম। এরই মধ্যে আমার প্রথম বিজ্ঞাপনটির প্রচার শুরু হয়। এ সময় বিভিন্ন পরিচালকের কাছ থেকে চলচ্চিত্রের কাজের অফার আসতে থাকে। প্রয়াত পরিচালক মমতাজ আলী ও ক্যাপ্টেন এহ্তেশাম আমাকে চলচ্চিত্রের কাজের প্রস্তাব দিলে আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি কাজ করা না করা নিয়ে। তখন এহতেশাম আঙ্কেল আমাকে 'শারমিন' নাম দিয়েছিলেন। এই নামে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়। সেই সময় আনন্দ বিচিত্রায় আমার ছবি দেখে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান হঠাৎ একদিন আমাদের বাসায় হাজির হন। তবে পরিচালক হিসেবে নন, সাকিব লোহানীর বাবা সেজে। তিনি সেদিন কৌশলে জানতে চেয়েছেন আমি চলচ্চিত্রে কাজ করবো কিনা, মূলতঃ ওটাই ছিল চলচ্চিত্রে কাজের বিষয়ে সরাসরি অফার। তারপর আমার কাছে আনন্দ মেলা থেকে ছবির অফার আসে। অফারটা নিয়ে আসেন সাংবাদিক মুশফিকুর রহমান গুলজার, ব্যাটে বলে মিল গেল বলে আমি কাজ করতে রাজি হই।'
চলচ্চিত্রের পথে যাত্রা
দেশীয় চলচ্চিত্রে দর্শক বারবার একই মুখ দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত হয়ে নতুন মুখ খুঁজছিলেন, তখন নাঈম-শাবনাজের পথ ধরে মৌসুমীর আবির্ভাব ঘটে চলচ্চিত্রে। আর তার এ পথের সহযাত্রী হলেন মরহুম নায়ক সালমান শাহ্। মৌসুমী সালমান শাহ্কে জুটি করে হিন্দি ছবি 'কেয়ামত সে কেয়ামত তক'-এর কপি রাইট কিনে ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিলেন আনন্দ মেলা সিনেমা লিমিটেড। সময়টা ছিল ৩ আগস্ট, ১৯৯২। জমকালো এক অনুষ্ঠানে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান পরিচয় করিয়েদিলেন মৌসুমী ও সালমান শাহ্কে। ওই সময় মৌসুমী উপস্থিত সবার দোয়া চাইলেন। তার কথা বলার ধরন দেখে মুহূর্তেই অনেকে বলেছিলেন এ মেয়েকে দিয়ে হবে। চলচ্চিত্রে একটি ভাল জায়গা করে নিবে মেয়েটি। সবার অনুমানের যথার্থতা প্রমাণ করলেন মৌসুমী। প্রথম ছবি 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' বাম্পার ব্যবসা করল। আর এ ছবির ব্যবসা সফলতাই মৌসুমীর নামের পাশে তারকা তকমাটি জুড়ে দেয় পরম আত্মবিশ্বাসের সাথে।
সাফল্য মৌসুমীর পথে চলে
গুণী শিল্পীরা তাদের সুনিপুণ কর্ম দিয়ে নিজের মতো করে একটি পথ তৈরি করে নেন। তারা যখন সেই পথে হাঁটেন সাফল্য তখন তাদের পিছু নেয়। তেমনি মৌসুমী কখনো সাফল্যের পেছনে ছুটেননি। তার কর্মগুণে সাফল্যই মৌসুমীর পেছনে ছুটেছে। প্রথম ছবির সফলতা মৌসুমীকে কাজ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কখনো মানের বিষয়ে আপস করেননি তিনি। একের পর এক ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে নিজেকে তিনি এমনই এক উচ্চ আসনে নিয়ে গেছেন সেখানে মৌসুমীর তুলনা কেবল মৌসুমীই। এপর্যন্ত কতগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন তা ঠিক গুণে রাখেননি মৌসুমী 'তার কথায়, এপর্যন্ত কতগুলো ছবিতে কাজ করেছি এর সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো এ মুহূর্তে দিতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আর এক বছর পর হয়তো অভিনীত ছবি নিয়ে ডাবল সেঞ্চুরীর অনুষ্ঠানটি করতে পারতাম।'
নিজের এবং তার কাজের প্রতি বরাবরই বেশ সচেতন মৌসুমী, ক্যারিয়ারের এ পর্যন্ত আসতে অনেক বুদ্ধির খেলা খেলতে হয়েছে তাকে। যে পরিস্থিতিতে যেমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল, তেমনটিই নিয়েছেন তিনি। অশস্নীল ও কাটপিস জুড়ে দেয়া ছবির দাপটে সুস্থ ধারার ছবির শিল্পীরা যখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এমন পরিস্থিতিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন মৌসুমী। এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে আড়াল করেননি সুস্থ ছবির পক্ষে আন্দোলন থেকে। শুধু তাই নয় ভাল ছবির নির্মাতাদের পাশে থেকে এ ধারার ছবি নির্মাণে তাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন সব সময়। আর এ কাজে নিজের সম্মানীতে ছাড় দিয়ে শিডিউলে পর্যন্ত সময় রেখে ভাল ছবিগুলো নিজের ঝুলিতে ভরে নিয়েছেন। এছাড়া মৌসুমী রুবেল কিংবা মৌসুমী-মান্না জুটি যখন দর্শকদের কাছে এক ঘেয়ে হয়ে উঠল, মুটিয়ে যাওয়া বা সিনিয়র হিসেবে নতুন নায়কদের বিপরীতেও মৌসুমীকে নিতে চাচ্ছেন না নির্মাতারা। তখন বুদ্ধির খেলা খেলে একটু বিরতি দিয়ে সময়কে জয় করলেন তিনি।
এক নজরে মৌসুমী
নামঃ আরিফা আখতার জামান
ডাক নামঃ মৌসুমী
জন্মঃ ৩ নভেম্বর ১৯৭২
জন্মস্থানঃ খুলনা
বাবার নামঃ নাজমুজ্জামান মনি
মায়ের নামঃ শামীমা আখতার জামান
ভাই বোনঃ তিন বোন' (বড়) মৌসুমী, মেজো সি্নগ্ধা, ছোট ইরিন
বিয়েঃ ২ আগস্ট ১৯৯৬
স্বামীর নামঃ ওমর সানি
ছেলে-মেয়েঃ ছেলে ফারদিন, মেয়ে ফাইজা।
প্রথম বিদেশ ভ্রমণঃ ভারতে
প্রথম ছবিঃ কেয়ামত থেকে কেয়ামত
প্রথম নাটকঃ আড়াল
প্রথম বিজ্ঞাপনঃ মেরিল স্প্রিং রেইন শ্যাম্পু
প্রথম বিদেশে শুটিং: 'বউয়ের সম্মান' ছবির জন্য থাইল্যান্ডে। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন মৌসুমীর বাবা।
0 comments:
Post a Comment