Breaking News
Loading...
Saturday, May 12, 2012

কমল দাশগুপ্ত, সঙ্গীতে বিরল প্রতিভাবান একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। খ্যাতির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিরলস সাধনা করে গেছেন সঙ্গীতের, করেছেন একের পর এক নতুন নতুন সুরের সৃষ্টি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু সঙ্গীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন অতি উচ্চ আসনে। ক্ল্যাসিক্যাল, সেমি-ক্ল্যাসিক্যাল, নজরুল সঙ্গীত, শ্যামা সঙ্গীত, গজল, কীর্তন, ইসলামী ও আধুনিক গানসহ সঙ্গীতের নানা শাখায় করেছেন সৃষ্টিশীল ও মননশীলতার উজ্জ্বল এবং অবাধ বিচরণ। এই সুরস্রষ্টার সুর ও সঙ্গীতায়োজনে আছে প্রায় আট হাজারের(৮০০০) মত গান।
১৯১২ সালের জুলাই মাসে কমল দাশগুপ্তের জন্ম। পিতা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে তাদের বাড়ি। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত নজরুলের নিকট তাঁর সুরের মায়াজাল বোনা। সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও মাস্টার কমল নামে নজরুল সঙ্গীত গেয়েছেন।

পিতার ব্যবসা উপলক্ষে তারা বেশ কয়েক বছর কুমিল্লায় অবস্থান করেন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি বি.কম পাশ করেন।

কমল দাশগুপ্ত নজরুলের বেশ কয়েকটি গানে সুর করেছেন। তিনি জীবনের একটা বড় অংশ কাটিছেয়েন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একান্ত সান্নিধ্যে। দুজনেই উস্তাদ জমিরউদ্দিন খানের কাছে থেকে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। প্রায় চারশত(৪০০)র অধিক পরিমাণ নজরুলগীতির সুরকারও তিনি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং নিজে শুধুমাত্র কমল দাশগুপ্তকেই কবির অনুমতি ছাড়াই কবির নিজের লেখা গানে সুর বসানোর অধিকার দিয়েছিলেন।

মাত্র ২০ বছর বয়সে এইচ.এম.ভি(The Gramophone Company of India where HMV represents ‘His Master’s Voice’) তে জয়েন করেন এবং প্রধান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ ২৫ বছর কাজ করেন। যূথীকা রায়, হেমন্ত মুখার্জী, জগমোহন মিত্র, তালাত মাহমুদ ও ফিরোজা বেগম সহ অনেকেই উনার কাছ থেকে সঙ্গীতের তালীম নিয়েছেন এবং উনার সুরারোপে গান করেছেন। এছাড়াও প্রায় ৯০টির মত ছায়াছবিতে করেছেন সঙ্গীত পরিচালনা। এই উপমহাদেশে উনার সমকক্ষ কিংবা প্রতিদন্ধী একমাত্র উনি নিজে ছাড়া দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই। সঙ্গীতের এই কিংবদন্তীর শ্রেষ্ঠত্ব তাই শুধু উনার নিজের সাথেই তুল্য।

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর রণসঙ্গীত ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ কমল দাশ গুপ্তর অনন্য সৃষ্টি। ১৯৫৮ সালে তাঁর সুরারোপিত গানের সংখ্যা সাত হাজার হওয়ায় এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি তাঁর সিলভার জুবিলী পালন করে। প্রতিমাসে গড়ে ৪৫টি গান সুর করার কৃতিত্ব ছিল কমল দাশগুপ্তের।

ফিরোজা বেগম, একমাত্র পরিচয় হিসেবে বলা যায় তিনি একজন নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। ফিরোজার বড় দুলাভাইয়ের অপব্যবহারে ফিরোজা তখন কোলকাতায় অবস্থান করেন। প্রায় একযুগ পর পূর্ব পরিচিত ফিরোজার সান্নিধ্যে আসেন কমল। ১৯৫৫ সালে তাঁরা দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

বৈষয়িক দিকে উন্নতি লাভ করতে না পারলেও চরম অর্থনৈতিক কষ্টে দিন কাটছিল তাঁদের। ভ্রাতা কণ্ঠশিল্পী ও ডাকসাইটে আমলা আসাফদ্দৌলা ফিরোজার কনিষ্ঠ ভাইয়ের হয়তো গোপন ইঙ্গিতে ১৯৬৭ সালে তাঁরা ঢাকায় ফেরেন। তখন তাদের ৩টি সন্তান। অরুণ, হামিন, ও সাফিন। ফিরোজা ছিলেন উচ্চাভিলাষী। ফ্যাশন ও সৌন্দর্যচর্চা ছিল গানের চেয়ে প্রিয়। তাই কমলকে বোঝা চেষ্টা না করে তাঁর ব্যক্তিত্বকে ফিরোজা অবজ্ঞা করেছেন। ফলে কমলের নেশাসক্ত জীবন মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করে। কিন্তু কমলের ওই নেশাসক্ত জীবনে অমন সুন্দরীর লেগে থাকা শুধু জৈবিক জীবন নয়, তাদের অমর প্রেমের কথাও আমাদের মনে করিয়ে দ্যায়।
অর্থের প্রয়োজনে ঢাকার হাতিরপুলে কমল দাশগুপ্ত মুদির দোকান দেন। নজরুল প্রেমিক তালিম হোসেনরা তাকে কমল থেকে কামাল উদ্দিনে পরিণত করেন। তবুও সুদিন এলো না কমলের। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গীতিকার ও বেতার কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম প্রস্তাব দেন বেতারের নিজস্ব স্টুডিও এবং বিশেষ বাদ্যযন্ত্রী গোষ্ঠী তৈরি করার। জন্ম নিল ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস। সবই কমলের পরিকল্পনা। নানা ধরনের গানসহ কাওয়ালী গান রেকর্ড করেন কমল। আর চলচ্চিত্রে ‘কেন এমন হয়’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন। প্রিয়তমা ফিরোজার নাম নিয়ে ‘নজরুল গীতিমালা’ নামে বাংলা একাডেমি থেকে স্বরলিপি প্রকাশ করতে থাকেন। এ স্বরলিপির উদ্ভাবক কমল নিজেই। কারণ এ স্বরলিপির সাংকেতিক চিহ্ন ও কৌশল কমলের নিজের উদ্ভাবিত। মাঝে অসুস্থ্য হলেন।

১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই তিনি পরিবারকে অসীম সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন শেষ পারে। নজরুলের প্রায় দেড়’শ গানের সুর আজ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

সূত্রঃ আর্টস সাম হোয়ার ইন ব্লগ
লেখক: বাবু রহমানকবি ও কাব্য

0 comments:

Post a Comment