Breaking News
Loading...
Monday, June 18, 2012


স্কুল-কলেজের ছেলে মাত্রই বীজগণিত শব্দটার সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। যার সাহায্যে আমরা কী সহজেই না অজানা রাশির মান বের করে ফেলি। এটা গণিতের একটি শাখা। একে ইংরেজিতে বলা হয় 'আলজেবরা', এটা আসলে আরবি শব্দ। এই শাখাটির উৎপত্তি স্থল ভারত ও গ্রিসে। তবে নামটির নয়। নামটি এসেছে একজন আরব গণিতজ্ঞের গ্রন্থ 'আলজিবর ওয়াল মুকাবিলা' থেকে। এই আরব গণিতজ্ঞের পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি। মূলত খোয়ারিজমি নামেই তিনি পরিচিত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পারস্যের অন্তর্গত আরল হ্রদের দক্ষিণে খিভা প্রদেশে খোয়ারিজম নামক স্থানে। এজন্যই তার নাম হয়েছিল আল-খোয়ারিজমি। তিনি মারা যান ৮৪৭-৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
জর্জ সার্টন খোয়ারিজমিকে তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ বলে অভিহিত করেছেন। আরবের তিনিই প্রথম বীজগণিতজ্ঞ। আল খোয়ারিজমির প্রধান চর্চার বিষয় গণিত হলেও তিনি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত, হিন্দু অংকপাতন পদ্ধতি ও বীজগণিত সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। খলিফা আল মামুনের প্রেরণায় তিনি আকাশের একটা মানচিত্র প্রণয়ন করেন। আকাশের বহু জানা অজানা তথ্য ও নক্ষত্রগুলোর অবস্থিতি দিয়ে এই মানচিত্র সমৃদ্ধ।
খোয়ারিজমি খলিফা আল মামুনের গ্রন্থাগারের গ্রন্থগারিক ছিলেন। আল মামুনের দরবারে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের একজন ছিলেন।
তিনি খলিফার নির্দেশে জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ ও তালিকা পুনঃপরীক্ষার কার্যে ও ভারতীয় সিদ্ধান্তের আলোচনা ও ব্যাখ্যা তৈরিতে আগ্রহী হন। গণিতের প্রতি তার প্রতিভা আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো খলিফা আল মামুন তাকে এক বৈজ্ঞানিক মিশনের সঙ্গে পাঠান। ফলে তিনি আফগানিস্তান ও পরে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেছিলেন। এর ফলেই ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং গণিতজ্ঞ প-িতদের সঙ্গে মিলিত হন। গণিতের প্রতি তিনি আরও ভালোভাবে আকৃষ্ট হন।
বীজগণিতের ক্ষেত্রে ভারত ও গ্রিসের যৌথ অবদানের কথা স্বীকৃত হলেও পশ্চিমা দুনিয়ায় গ্রিস থেকে নয়, আরবের মাধ্যমে এ গণিতের প্রসার লাভ করেছিল। আর আরবরা তা পেয়েছিল ভারতের কাছ থেকে। তারা আবার ভারতীয় জ্ঞান-পিপাসুদের গ্রিক-আরবীয় জ্ঞান রাজ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইউক্লিডের এলিমেন্টস, টলেমির 'আলমাজেস্ট' এবং 'আস্তরলাব' নির্মাণ বিষয়ক গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
আল-খোয়ারিজমির বীজগণিত হিন্দু গণিতজ্ঞদের কাছ থেকে ধার করা নয়, কারণ রাশিগুলো সুবিধামতো সমীকরণের একদিক হতে অন্যদিকে অপসারণ করে প্রত্যেক রাশিকে ধনাত্মক করার চেষ্টা ভারতবর্ষের গণিতজ্ঞাদের মধ্যে দেখা যায় না। আবার বলা যায় ডায়োফ্যান্টাসদের মতো গ্রিক গণিতজ্ঞদের গবেষণা থেকেও গৃহীত হয়নি, কারণ গ্রিক গণিতজ্ঞরা দ্বিঘাত সমীকরণের যে একটি মাত্র মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন তাহলো অমূলদ রাশিকে বাদ দেয়া। কিন্তু দ্বিঘাত সমীকরণের দুটো সমাধানের একটি অমূলদ তা এই আরবীয় গণিতজ্ঞের আলোচনায় দেখা যায়। আসলে তিনি বীজগণিতের এক নতন পথ রচনা করেছিলেন। যা আরবীয় বীজগণিত নামে পরিচিত। তবে এই বীজগণিত ভারত ও গ্রিক বীজগণিতের ওপর নির্ভরশীল না হলেও এই দুদেশের বীজগণিত চর্চা ও কার্যক্রম থেকে খোয়ারজমি প্রেরণা লাভ করেছিলেন বলা যায়। এই ধারা বজায় রেখে আরবরা চর্চার মাধ্যমে বীজগাণিত গবেষণাকে উন্নত স্তরে পেঁৗছে দিয়েছিলেন।
আলজিবর ওয়ালমুকাবিলা (অষ-লবনৎ ড্থধষসঁয়ঁধনধষধ) খোয়ারিজমির সর্বশ্রেষ্ঠ বীজগাণিত গ্রন্থ। এছাড়াও হিন্দুদের গণনা ও দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি লিখিত কিতাবুল হিন্দ ও পাটিগণিত সম্পর্কে লিখিত বই 'আলজাম ওয়াল তাফরিক' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অ্যাডেলার্ড অব বাথ ও রাবার্ট অব চেষ্টার এই বইগুলোর অনুবাদ করেন। 'আলজিবর ওয়ালমুকাবিলা' গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় বিভিন্ন নামে অনুদিত হয়।
গ্রন্থের নামের সঙ্গে লেখকের নামও অনেক পরিবর্তিত ও বিৃকত হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে অষমবনৎধ ড়ভ অষসধপযধনবষ নামে একটি ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায় এবং ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এফ রোজেন এই গ্রন্থের আরেকটি ইংরেজি অনুবাদ প্রণয়ন করেন অষমবনৎধ ড়ভ গড়যধসসবফ ইবহ গঁংধ নামে। সূর্য ঘড়ি সমপর্কেও তিনি একখানা বই লিখেন। সহকর্মীদের নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল নিয়ে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন, গ্রন্থটির নাম ফিজি।
আমরা জানি যে প্রাচীন ভারতীয়রা শূন্য সংখ্যা ব্যবহার করে সংখ্যা গণনার যে পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটান তা পরে আরবদেশীয়রা তাদের গণনার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করে নেন। এটাই তাদের তথাকথিত আরবি চিহ্ন নামে পরিচিত। এবং তাদের কাছ থেকে এই সংখ্যা চিহ্নগুলো গ্রহণ করেন অন্যান্য দেশের মানুষ। গ্রিক ও ভারতের তথা প্রাচীন বিজ্ঞানের তথ্যাবলী আমরা জানি এই আরব ও পারস্যের দুর্ধর্ষ জ্ঞানসাধকদের কাছ থেকে।
ওই সব প্রাচীন গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন নিজেদের ভাষায়, আবার নিজেদের গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন অন্যান্য ভাষায় ব্যাপক মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে। আজ আমরা প্রাচীন সময়ের বিজ্ঞানের সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যতদূর আসতে পেরেছি তার অন্যতম কারণ এই আরবীয় বিজ্ঞানসাধকরা যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি।

0 comments:

Post a Comment