Breaking News
Loading...
Wednesday, April 7, 2010

পঞ্চাশের দশকে হিন্দি সিনেমার গানে যখন লতা মুঙ্গেশকরের রাজত্ব, তখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল এক গায়কের নাম গীতা দত্ত। পুরো নাম গীতা ঘোষ রায় চৌধুরী। গীতা দত্ত ১৯৩০ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার এক ধনাঢ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি মা-বাবার সঙ্গে ভারতের মুম্বাই চলে যান।
ছোটবেলা থেকেই গান শিখতেন। একদিন প্রতিবেশী পণ্ডিত হনুমান প্রসাদের কানে এসেছিল সেই সুর। সে-ই শুরু। হনুমান প্রসাদেরই সংগীত আয়োজনে 'ভক্ত প্রহ্লাদ' ছবির গানে সহশিল্পী হিসেবে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রথম আত্দপ্রকাশ। সেটি ১৯৪৬ সালের কথা। তবে সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কাঁপন ধরালেন পরের বছর শচীন দেব বর্মণ সুরারোপিত 'দু ভাই' ছবির মাধ্যমে। ছবিতে তাঁর গাওয়া 'মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গায়া' গানটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল গীতার কণ্ঠের জাদু। জন্ম নিল নতুন এক গানের পাখি। গীতা দত্ত প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে ১৯৪৬ সালে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। বাংলা ও হিন্দিতে সমান পারদর্শিতায় গান করেছেন। তিনি সব ধরনের গান করেছেন। তাঁর মধ্যে ভজন, কীর্তন, আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান অন্যতম।
শচীন দেববর্মণের সুরে গীতা দত্তের গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে, ‘মেরা সুন্দর স্বপ্ন ভীত গাইয়া’, ‘ওহ্ স্বপ্নেওয়ালি রাত’, ‘তদবির সে বিগদি হুই তাকদির’, ‘আন মিলো আন মিলো’, ‘আজ সাজন মোহে অঙ লাগলো’, ‘হাওয়া ধীরে আনা’, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া কায়া হাসিন সিতাম’ প্রভৃতি।
ও পি নাইয়ায়ের সুরে গাওয়া গীতা দত্তের জনপ্রিয় গানগুলো হচ্ছে ‘জারা সামনে আ’, ‘বাবুজি ধীরে চল না’, ‘ঠান্ডি হাওয়া কালি ঘাটে’, ‘জব বাদল লেহরায়া’, ‘মেরে জিন্দিগি কি হামসফর’, ‘চোর, লুটেরে, ডাকু’, ‘মেরা নাম চিন চিন চো’, ‘কায়সা জাদু বালাম তুনে দরা’ প্রভৃতি।
এসব গানই জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান। সিনেমাগুলোর মধ্যে বাজি (১৯৫১), পয়সা (১৯৫৭), কাগজ কি ফুল (১৯৫৯), আর পার (১৯৫৪), মি. অ্যান্ড মিসেস ৫৫ (১৯৫৫) অন্যতম। কলকাতার বাংলা ছবিতে প্রায় ১৭টি গান গেয়েছিলেন তিনি।। নচিকেতা ঘোষের সুরে ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'পৃথিবী আমারে চায়' ছবিতে 'নিশি রাত বাঁকা চাঁদ' ছাড়াও একই ছবির রাগাশ্রয়ী 'তুমি বিনা এ ফাগুন বিফলে যায়' গানটি গেয়েছিলেন গীতা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে 'হারানো সুর' ছবির 'তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার' বাংলা রোমান্টিক গানের জগতে এক মাইলফলক। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া 'হসপিটাল' ছবির সেই বিখ্যাত গান 'এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়' আমাদের সেই সোনালি যুগে নিয়ে যায়।
 সিনেমার গান রেকর্ড করতে গিয়ে গীতা দত্ত নায়ক ও উঠতি পরিচালক গুরু দত্তের সান্নিধ্যে এসে হূদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৫৩ সালের ২৩ মে দুজন বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। গুরু দত্ত ১৯৫৭ সালে গৌরী ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। গীতা দত্ত তা মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এই বিবাহবিচ্ছেদের পর গীতা দত্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং কার্যত তাঁর ক্যারিয়ারের যবনিকা ঘটে।
অন্যদিকে অতিরিক্ত মদ্যপান ও ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে ১৯৬৪ সালে গুরু দত্ত মৃত্যুবরণ (অনেকের ধারণা, এটি ছিল আত্মহত্যা) করেন। এ সময় গীতা দত্ত আরও ভেঙে পড়েন। একই সঙ্গে আর্থিক সমস্যায় পড়েন। এ সমস্যা কাটানোর জন্য তিনি আবার তাঁর গানের ক্যারিয়ারের দিকে নজর দেন। নানাভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি বধূ বরণ (১৯৬৭) নামের একটি ছবিতে অভিনয়ও করেন। গান করেন অনুভব (১৯৭১) ছবির জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর তাঁর ক্যারিয়ারে ভালোভাবে ফিরতে পারেননি। অতিরিক্ত মদ্যপান এরই মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ ছিল না। ফলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৪১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন হারানো সুর-এর এই শিল্পী। কিন্তু তাঁর গান হারিয়ে যায়নি।

0 comments:

Post a Comment