Breaking News
Loading...
Tuesday, June 22, 2010

অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, চিন্তানায়ক জাঁ পল সার্ত্রের জন্ম ফ্রান্সের প্যারিস শহরে, ১৯০৫ সালের ২১ জুন। ফরাসী নৌবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর পিতা জ্যঁ ব্যাবিস্টে সার্ত্রে । যদিও সার্ত্রে’র ১৫ মাস বয়সে মারা যাওয়া এই বাবা সম্পর্কে কখনই উল্লেখ করার মতো কিছু আসেনি সাত্রে’র লেখায়। অন্যদিকে ১৯৫২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী আলবার্ট সোয়াইৎজার ভ্রাতুষ্পুত্রী আনেমারি তাঁর মা। শৈশবে একটি বড় সময় কেটেছে যাদের সঙ্গে সেই মা এনি ম্যারি এবং দাদা চার্লস শোয়েটজারের প্রভাবকেই জীবনে বড় বলে মেনেছেন সার্ত্রে। যদিও সার্ত্রে’র বয়স যখন নয় তখন দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মায়ের সাথেও খানিকটা দূরত্ব বাড়ে সার্ত্রে’র। সেই সাথে আশৈশব স্কুল এবং কলেজের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সার্ত্রে’র আচরণে অনিশ্চয়তা এবং জেদের বিষয়গুলোও স্পষ্ট হতে থাকে।
জ্যঁ পল সার্ত্রের জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। একদিকে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির তেমন তোয়াক্কা করেননি। অপরদিকে যখন যা সঠিক বলে মনে করেছেন তাই-ই অকপটে ব্যক্ত করেছেন। আমরা তাঁর শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের উপর আলোকপাত করে তাঁর জীবনের বিশাল ব্যাপ্তি ও পরিধির সন্ধান পাই। জ্যা পল সার্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্যারিস শহরের লিসে দ্য ল’ রোসেইয়া এবং লিসে লেগ্রাঁদ স্কুলে। এরপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন ইকোলে নরমালে সুপিরিউর কোর্সে। সাফল্যের সাথে কোর্স সমাপ্ত করে হাভ্র, লাঁও এবং নয়নিতে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। মূলত কৈশোরের মাঝামাঝি সময় থেকেই দর্শনের প্রতি আগ্রহ অনুভব করতে থাকেন সার্ত্রে। স্বীয় আগ্রহ আর কৌতূহল থেকে প্যারিসের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একোলি নরমাল সুপেরিয়ের থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন। এছাড়া ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সংস্পর্শেও ক্রমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন সার্ত্রে। সেই সাথে চলতে থাকে কেন্ট, হেগেল এবং হেইডেগারের মতো দার্শনিকদের তত্ত্ব থেকে ধারণা লাভের প্রক্রিয়াটিও। এরই মাঝে ১৯২৯ সালে সার্ত্রের পরিচয় ঘটে সেই সময়কার আরেক আলোচিত লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ার সঙ্গে, যার সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি চমৎকার সম্পর্ক বজায় ছিল সার্ত্রে’র। এরপর সার্ত্র ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত টানা ৫ বছর মিসর, গ্রীস, ইতালি ও জার্মানি ঘুরে বেড়ান। প্রাচীন সভ্যতার এসব নগরী ঘুরে তিনি দার্শনিক জিজ্ঞাসার বিভিন্ন তথ্য, উপাত্তের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন। ১৯৩১ সালে দর্শনের প্রফেসর হিসেবে লা হার্ভেতে যোগ দেন সার্ত্রে। আর এর ঠিক পরের বছরেই বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে দর্শনশাস্ত্রের ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করতে যান তিনি। এ সময় সমকালীন ইউরোপের অনেক বড় মাপের দার্শনিকদের সাথেও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠে সার্ত্রে’র। যদিও সার্ত্রে’র জীবন ও কর্মের ওপর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় ফরাসি সৈন্যবাহিনীর সাথে একজন ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবেই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে যান সার্ত্রে। তাঁর দার্শনিকতা ও জীবন জিজ্ঞাসা আরও ব্যাপক আকাঙক্ষার জন্ম দেয়। ফলে একদিকে তিনি ১৯৩৫ সালে প্যারিসের লিসে কঁদরসে শিক্ষকতা শুরু করেন। অন্যদিকে এডমুন্ড হুসরল ও মার্টিন হাইত্তোগার-এর কাছে দর্শনশাস্ত্র পাঠ করতে থাকেন। এভাবেই চলতে থাকে তাঁর দর্শনচর্চা। কিন্তু এর মধ্যে বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এ সময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি নাৎসীদের হাতে বন্দীও হন। জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থাতেই রচনা করেন তার প্রথম নাটক। যদিও অসুস্থতার কারণে বন্দি হবার বছরখানেকের মাথাতেই সার্ত্রেকে মুক্তি দেয় নাজি বাহিনী। তবে যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তার পর্যবেক্ষিত বাস্তবতা গভীর ছাপ ফেলে যায় সার্ত্রে’র জীবন ও দর্শনে। এ সময় প্যারিসে ফিরে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপে(নাৎসী বিরোধী দলে)র সাথেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন সার্ত্রে। সেই সাথে ক্রমান্বয়ে বেগবান হতে থাকে সার্ত্রে’র স্বতন্ত্র লেখনীও। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে প্যারিসে যুদ্ধাবসানের সময়কালে জোরদার লেখনী দিয়ে ক্রমেই তার দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে অন্যদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন সার্ত্রে। এরপর তিনি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। তাঁর এসব বক্তৃতা খুবই প্রশংসিত হয় এবং তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই পাশ্চাত্য জগতের এ দার্শনিক চিন্তানায়ক সারাবিশ্বে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। মার্কসবাদ ঘেঁষা তাঁর দার্শনিক মতবাদ তাঁর মনোভঙ্গিও তদনুরূপ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ল’ ত্রে এত্ল্য নিয়াত বা বিং এন্ড নাথিং নেস প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। এরপর তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ ‘লেস্ শেমিনস্ দ্য লা লিবার্তে’ তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। সার্ত্রের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ‘ক্রিতিক দ্য লা রেসঁ দিয়া লেক্তিক’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৭১ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্লরেয়ার’ প্রকাশিত হলে সারাবিশ্বে বিস্ময়কর আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
ব্যক্তিজীবনে সমাজতান্ত্রিক কোনো দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও নানা সময়ে তার লেখনীতে খুঁজে পাওয়া যায় এ ধারার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি। এছাড়া নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্বাস ও স্পষ্ট ভাষণের কারণে নানা সময়ে বহু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে সার্ত্রেকে। এমনকি আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধেরও কট্টর সমালোচক ছিলেন সার্ত্রে। অন্যদিকে নানা সময়ে সার্ত্রে’র যে লেখনীগুলো তাকে বিশ্ব-দরবারে স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হওয়া সার্ত্রে’র প্রথম উপন্যাস ‘লা নাজি’, ‘দ্য মুর’, ‘ব্যারিওনা’ (প্রথম নাটক), ‘দ্য ফ্লাইজ’, ‘নো এক্সিট’, ‘দ্য এজ অব রিজন’, ‘দ্য রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট’, ‘দ্য ভিক্টরস’, ‘দ্য চিপস্ আর ডাউন’, ‘ইন দ্য ম্যাস’, ‘ডার্টি হ্যান্ডস’, ‘ট্রাবলড পি’, ‘দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড’, ‘কিন’, ‘দ্য কনডেমড অব আলটোনা’, দ্য ট্রোজান ওম্যান’, ‘দ্য ফ্রড সিনারিও’ প্রভৃতি। মূলত উল্লিখিত এ সবগুলোই ছিল সার্ত্রে’র লেখা উপন্যাস, নাটক ও ছোটগল্পের তালিকা। আর এসবের বাইরে দার্শনিক যেসব প্রবন্ধ ও সমালোচনা দিয়ে সার্ত্রে বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন তার মধ্যে রয়েছে ‘ইমেজিনেশন : এ সাইকোলজিক্যাল ক্রিটিক’, ‘দ্য ট্রানসেন্ডেন্স অব দ্য ইগো’, ‘স্কেচ ফর এ থিওরি অব দ্য ইমোশন্স’, ‘দ্য ইমেজিনারি’, ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’, ‘এক্সিসটেনসিয়ালিজম ইজ এ হিউম্যানিজম’, ‘সার্চ ফর এ মেথড’, ‘ক্রিটিক অব ডায়ালেকটিক্যাল রিজন’, ‘এন্টি সেমাইট অ্যান্ড জিউ’, ‘বদলেয়ার’, সিচুয়েশন সিরিজ (ওয়ান টু টেন), ‘ব্ল্যাক অরফিউজ’, ‘দ্য হেনরি মার্টিন অ্যাফেয়ার’ প্রভৃতি। এছাড়া সার্ত্রে’র লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সার্ত্রে বাই হিমসেল্ফ’, ‘দ্য ওয়ার্ডস’, ‘উইটনেস টু মাই লাইফ কোয়াইট মোমেন্টস ইন এ ওয়ার’ এবং ‘ওয়ার ডায়েরি’স’। ব্যক্তি মানুষের হয়ে কলম ধরার কারণে বহুবারই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন সার্ত্রে। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে বেশ ক’বার। 
আগেই বলেছি জঁ-পল সার্ত্র্‌ প্রথাবিরোধী লোক। তিনি বিয়ে করেননি, বিখ্যাত ফরাসী নারীবাদী লেখিকা সিমন দ্য বুভেয়ার সাথে বসবাস করেছেন আজীবন। সার্ত্রে ও বান্ধবী বুভেয়া’র মিলে ‘লেস ভেজপস মোদারনেস’ নামক মাসিক পত্রিকা বের করতেন। এ পত্রিকাটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তাঁর বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু বেঁকে বসেন জা পল সার্ত্রে। যথাসময়ে তাঁকে এ পুরস্কার দেয়া হয়নি। এই অভিযোগ তুলে তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। অবশেষে ফুসফুস সংক্রান্ত জটিলতা এবং শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে জন্মস্থান প্যারিসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহান দার্শনিক, চিন্তানায়ক জ্যঁ পল সার্ত্রে।

0 comments:

Post a Comment