Breaking News
Loading...
Thursday, July 1, 2010

দার্শনিক ও স্বনামধন্য লেখক জাঁ জ্যাক রুশো ১৭১২ সালের ২৮ জুন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় জন্মগ্রহণ করেন। যদিও জঁ-জাক রুসোর জন্মভূমি সুইজারল্যান্ড, তাঁর জীবন ও কর্ম আবর্তিত হয়েছে ফ্রান্সকে ঘিরে। তবে জীবনের সিংহভাগ সময় তিনি ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। তাঁর লেখালেখিও ফরাসি ভাষায়। রুশোর দর্শনের ভিত্তি ছিল রাজনীতি কেন্দ্রিক। মহান ফরাসি বিপ্লবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে যাদের লেখা, তিনি তাদের অন্যতম। একথা সর্বজনবিদিত রুশো, ভলতেয়ার দিদেরো এই ত্রয়ী দার্শনিক, লেখকের চিন্তা ধারাই ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। জানা যায়, জন্মদানকালে রুশোর মা মারা যান। তিনি বাবার যত্নে বড় হতে থাকেন। বাবা যেমন একদিকে মাতৃহারা ছেলেটিকে স্নেহ ও আদর যত্নে আগলে রাখতেন, আবার জন্মদানকালে মা মারা যাওয়ায় তাকে ‘অপয়া’ বলে ভর্ৎসনাও করতেন। এভাবে রুশোর বয়স যখন দশ, তখন তাঁর বাবা তাকে ঘরে রেখে একদিন চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ হলেন। এ ঘটনা রুশোকে যেমন বেদনাহত করেছে, তেমনি সারাজীবন একধরনের পাপবোধও তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। স্কুলে ভর্তি হন তিনি কিন্তু সেখানে মন টেকেনি। এরপর একজন ভাস্কর্য শিল্পীর সঙ্গে শিক্ষানবিশীর কাজ শুরু করেন। একাজও তাঁর ভাল লাগলো না। শিক্ষানবিশীর কাজ ফেলে পালালেন তিনি। আল্পস্ পাহাড়ের স্যাভয়ের কাছে এক ধনী বিধবা মহিলার কাছে আশ্রয় নেন। ডি ওয়ান্স নামের বিধবা মহিলার আশ্রয়ে কাটান জীবনের দশটি বছর। এক সময় তাঁর চেয়ে তেরো বছরের বড় এ বিধবা মহিলা রুশোর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। ইচ্ছে প্রকাশ করেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার। রুশো এ বিষয়ে তাঁর অস্বীকৃতি জানান। ফলে এখানকার পাঠ চুকিয়ে তিনি প্যারিসে চলে যান। এ বিদুষী বিধবা মহিলার সুবাদে ইতোমধ্যেই তিনি ইউরোপের অনেক জ্ঞানী-গুণীর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন।

প্যারিসে শুরু হয় তাঁর অন্যরকম জীবন। তিনি এক নতুন ধারার সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। তাঁর প্রবর্তিত এ নতুন ধারা প্যারিসের অভিজাত মহলে বেশ আলোড়ন তোলে। এ সময় তিনি সঙ্গীতের ওপর বেশকিছু সারগর্ভ প্রবন্ধ রচনা করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর সাহিত্য চর্চা। পরবর্তীতে এক্ষেত্রেই তিনি অর্জন করেন ব্যাপক সাফল্য, তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। এ সময় ফ্রান্সের পণ্ডিত ও চিন্তাবিদরা তাঁর লেখার ও দার্শনিকতার সমালোচনা শুরু করেন। সে সময় ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ছিল, রাজা ছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এ ধরনের প্রচারণা ও দাবি ছিল তাদের। ফলে বংশানুক্রমিক শাসন ও শোষণ চলছিল। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা যেতো না। রুশো, ভল্তেয়ার দিদেরো ছিলেন রাজতন্ত্রের ঘোরবিরোধী। তাদের লেখনী চলতে থাকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং রাজতন্ত্রের সহায়ক শক্তি ধর্মযাযকদের বিরুদ্ধে।

১৭৬২ সালে প্রকাশিত তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘দি সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে বলিষ্ঠ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা দেন। এ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি বলেন, ‘জোর যার মুল্লুক তার এ কথাটা কখনোই ঠিক নয়। আমাদের কর্তব্য হলো কেবল আইন সম্মত ক্ষমতাকে মেনে নেওয়া। তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র ন্যায়সঙ্গত শাসক হলো তাঁরা, যাদেরকে জনগণ স্বাধীনভাবে পছন্দ করে নেবে। তিনি আরও দাবি করেন-‘রাজাকে শাসন করার ক্ষমতা জনগণই দেবে, কোন ঈশ্বর নয়।’ তিনি দূর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘একটা ভাল রাষ্ট্র একমাত্র গণতান্ত্রিক উপায়েই গঠন সম্ভব। এই ১৭৬২ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস’ ‘এমিলি’ এবং ধর্মযাজকদের সমালোচনা করে লেখা ‘বিশ্বাসীদের পেশা’। এর ফলে রোমান ক্যাথলিকদের বিরাগভাজন হন তিনি। ধর্মীয় অনুভূমিতে আঘাত দেয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ সময় তিনি গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে জš§ভূমি সুইজারল্যান্ডে চলে আসেন। তাঁর বিপ্লবী চিন্তাধারা ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার বিরোধিতার কারণে সুইজারল্যান্ডের জনগণও তাঁকে পছন্দ করতো না। এখানেও তাঁর জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের পরামর্শে ইংল্যান্ড চলে যান। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ডেভিড হিউস তাকে পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে স্বাগত জানান। ১৭৭০ সালে তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে আবার ফ্রান্সে চলে যান।

তিনি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত লেখার কাজে আবার মনোনিবেশ করেন। প্যারিসে তার গুণমুগ্ধ ভক্তরা তাকে আগলে রাখেন। এক সময় তিনি ‘প্যারোনাইয়া’ নামক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ সময় তিনি বিড়বিড় করে বলতেন- ‘আমি কি দোষে অপরাধী?’ এভাবে কয়েক বছর অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা চলার পর ১৭৭৮ সালের ২রা জুলাই ৬৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। উল্লেখ্য এই ১৭৭৮ সালে ভল্তেয়ারও পরলোকগমন করেন। কিন্তু তারা যে বিশ্বাসের বীজ বুনেছিলেন, তাদের মৃত্যুর এক যুগ পার না হতেই তা সাফল্য লাভ করে। এ প্রসঙ্গে নেপোলিয়ান পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘যদি কোন জেন জ্যাকস রুশো না থাকত তাহলে হয়ত কোনদিন ফ্রান্সে কোন বিপ্লব সংঘটিত হতো না।’

0 comments:

Post a Comment