Breaking News
Loading...
Monday, August 16, 2010

বাংলা কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমান বাঙ্গালীর সাম্প্রতিককালের প্রধানতম কবি তিনি তার সারাজীবনের রচনায় মানুষকে আশার কথা বলেছেন।  স্বাধীনতার কবি গণ মানুষের কবি গণ জাগরণের কবি শামসুর রাহমান তিরিশের প্রধান কবিদের ভিন্ন জগত ভিন্ন অবস্থান থেকে কবিতাকে নিয়ে আসেন জনমানুষের সারিতে। কবিতাকে সমৃদ্ধ করেন স্বতন্ত্র এক জগতের আনন্দ, শোক ও উজ্জ্বলতায়। স্বাধীনতা, বন্দিত্ব, বিদ্রোহ, প্রেম, রাজনীতি, হতাশা, আশা, ক্ষোভ ও আনন্দ ছিল তার কবিতার উপজীব্য। তার অজর কবিতা পাঠ শেষে গণমানুষের প্রতি অসীম মমত্বে আমরাও ভাসি।

১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর বুধবার পুরনো ঢাকার মাহুতটুলির ৪৬নং বাড়িতে কবি জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম আমেনা খাতুন ও পিতার নাম মুখলেসুর রহমান চৌধুরী। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। বাবা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী ছিলেন বিভিন্ন পেশায় অস্থির; পুলিশের ইন্সপেক্টর থেকে সিনেমা হলের ব্যবসায়ী; সর্বশেষ প্রেস ব্যবসায় থিতু হন তিনি।

১৯৩৬ সালে ৭ বছর বয়সে ঐতিহ্যবাহী পোগোজ স্কুলে সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি হন তিনি। ওই স্কুলে তখন ক্লাস ওয়ান ছিল না। ওই সময় পোগোজ স্কুলে মোট ৮০০ ছাত্রের মধ্যে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ জন। বাকি সবাই হিন্দু। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছিন্নমুকুল কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটে শামসুর রাহমানের। ছোটবোনের মৃত্যুতে, ছিন্নমুকুল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীবনের প্রথম কবিতাটি লেখেন। স্কুলের পথে ছিল রামমোহন লাইব্রেরি। তার সদস্য হয়েছিলেন। শামসুর রাহমানের শৈশবে জ্ঞানের এক বিশাল দরজা খুলে দিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত ওই লাইব্রেরিটি। বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ও বসুমতীর মতো বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যপত্রগুলোর সঙ্গে তার সেখানেই প্রথম পরিচয়। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৈনিকদের আস্তানায় পরিণত হলে ঢাকা কলেজ ওই সময় রমনা থেকে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ৩ বছর পড়াশোনা করেও অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেননি। কিছুকাল বিরতি দিয়ে ১৯৫৩ সালে পাস কোর্সে বিএ পাস করে আবার ইংরেজিতেই এমএ করার ইচ্ছায় ভর্তি হন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও শেষ পর্বের পরীক্ষা না দিয়েই একাডেমিক শিক্ষার ইতি টানেন। এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন। এক বিয়ে বাড়িতে হ্যাজাকের আলোয় জোহরা বেগমকে দেখে শামসুর রাহমানের ভালো লেগেছিল। তারপর পারিবারিক রীতিতে বিয়ে। ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে_ সুমায়রা রাহমান, ফাইয়াজ রাহমান, ফাওজিয়া সাবরিন, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন ও সেবা রাহমান। পাড়াতলীর পারিবারিক পুকুরে ডুবে ছোট ছেলে মতিনের মৃত্যু হয়। সেখানেই তার কবর। মতিনকে নিয়ে 'তোর কাছ থেকে দূরে' শিরোনামে একটি করুণরসের কবিতা আছে শামসুর রাহমানের। কবিতাটি তার প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে বইয়ে সূচিবদ্ধ হয়েছে।

কবির ছেলেবেলা থেকে শুরু করে মধ্যবয়স (১৯৮৬ সাল) পর্যন্ত কেটেছে পুরান ঢাকার মাহুতটুলী আর পরবর্তীতে সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন বা আশেক লেনে।

১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭-১৯৫৯ রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রাম প্রডিউসার ছিলেন। ১৯৬০-১৯৬৪ দৈনিক মর্নিং নিউজে সিনিয়র সাব-এডিটর, ১৯৬৪-১৯৭৭ দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় সহকারী সম্পাদক এবং ১৯৭৭-১৯৮৭ দৈনিক বাংলার ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কবি শামসুর রাহমান ১৯ বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। সেটা ছিল ১৯৪৮ সাল। ১ম কবিতা ‘উনিশশো ঊনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলায়। সাপ্তাহিকটির সম্পাদক ছিলেন নলিনী কিশোর গুহ। ১৯৫৯ সালে 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা কবিতার ভুবনে নম্র পদযাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৬৬টি। উপন্যাস ৪টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি, ছড়ার বই ৮টি, অনুবাদ ৬টি। এছাড়াও খুবই মায়া জড়ানো বেশকিছু গান রচনা করেছেন।

মাহুতটুলী ও ইস্কাটন ছাড়াও পুরান ঢাকার অশেক লেনে শামসুর রাহমানের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কাটে। এরপর সপরিবারে কিছু দিন তল্লাবাগে থেকেছেন। বিশ শতকের আশির দশকের শেষভাগে শ্যামলীর বাড়িতে আসেন। স্ত্রী জোহরা রাহমান, পুত্র ফাইয়াজ রাহমান, পুত্রবধূ টিয়া রাহমান এবং দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে নিয়ে এখানেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান। উল্লেখ্য, শৈশবে পুরনো ঢাকা ছেড়ে কিছু দিনের জন্য ঢাকার ইস্কাটনেও থেকেছেন। এছাড়াও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে সপরিবারে কয়েক মাস পৈতৃক গ্রাম পাড়াতলীতে কাটান। কবিজীবনে তিনি সুযোগ পেয়েছেন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের। এর মধ্যে রয়েছে_ ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মিয়ানমার, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি।

তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। বইটির নাম_ 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'। এরপর কেবলই পথচলা। একে একে কবি লিখে ফেলেন 'রৌদ্র করোটিতে', 'বিধ্বস্ত নীলিমা', 'বন্দী শিবির থেকে', 'ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা', 'আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি', 'আমি অনাহারী', 'শূন্যতায় তুমি শোকসভা', 'বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে', 'প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে', 'কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি', 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ', 'আমার কোনো তাড়া নেই', 'ধুলায় গড়ায় শিরোস্ত্রাণ', 'এক ফোঁটা কেমন অনল', 'টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে', 'দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে', 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়'সহ অসংখ্য কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ।

শিশুসাহিত্য নিয়ে শামসুর রাহমান যতটুকু কাজ করেছেন ততটুকুতেই তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন। তার শিশুসাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_ 'এলাটিং বেলাটিং', 'ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো', 'স্মৃতির শহর', 'গোলাপ ফোটে খুকুর হাতে', 'নয়নার জন্য'।

শামসুর রাহমানের লেখা তিনটি উপন্যাস হচ্ছে_ 'অক্টোপাস', 'অদ্ভুত আঁধার এক', 'নিয়ত মন্তাজ'। শামসুর রাহমানের অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে_ ফ্রস্টের কবিতা, রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা, খাজা ফরিদের কবিতা, হৃদয়ের ঋতু (টেনিসি উইলিয়ামসের সামার অ্যান্ড স্মোক থেকে) এবং হ্যামলেট। শামসুর রাহমান তার সাংবাদিকতার পেশা ছাড়াও জড়িত ছিলেন ছোটকাগজ সম্পাদনার সঙ্গেও। তার সম্পাদিত পত্রিকা হচ্ছে_ কবিকণ্ঠ (ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে যৌথভাবে), অধুনা, মূলধারা।

শামসুর রাহমান তার সাহিত্যকর্মের জন্য দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে_ আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৭৭), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮১), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), মিতসুবিসি পুরস্কার, জাপান (১৯৮২), আনন্দ পুরস্কার, ভারত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি (১৯৯৪), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি (১৯৯৪), বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব প্রদত্ত কবিশ্রেষ্ঠ পদক (২০০০), আমাদের সময় সম্মাননা (২০০৬), দি সার্ক পোয়েট সম্মাননা, দিলি্ল (২০০৬)।

২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাংলাভাষী অগণিত ভক্ত_অনুরাগীকে বিষাদের সাগরে ভাসিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যান আমাদের এই স্বাধীনতার কবি।

0 comments:

Post a Comment