Breaking News
Loading...
Friday, August 20, 2010

একজন নারী। মানবতার বেদীমূলে নৈবেদ্যের থালায় যিনি নিজের জীবনকেই অর্ঘ্যরূপে নিবেদন করেছেন। তাঁর হাত ধরে এসেছে মুক্তি ঠিক যেমন ভোরের ¯স্নিগ্ধ আলো একটি নতুন দিনের বার্তা নিয়ে আবির্ভুত হয়। রোগ, শোক, জরা, মৃতু তাঁর হৃদয়কে ব্যাথিত করেছে। পীড়িত হৃদয়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে ভৌগলিক দূরত্ব যার কাছে বড়ো বেশি তুচ্ছ মনে হয়েছে তিনি মাদার তেরেসা।

ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মানুযায়ী তার মূল নাম অ্যাগনেস গোনাক্সা বোজাঝিউ। বাবা, মা আর তিন ভাই বোন নিয়ে ছিলো তাঁদের সংসার। অ্যাগনেস গোনাক্সা বোজাক্সিউ ছিলেন সবার ছোটো। আলবেনিয়ায় ম্যাসিডোনিয়ার স্কপজে শহরে জন্মে ছিলেন তিনি। সময়টা ছিলো ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। তার বাবা বংশগতভাবে ছিলেন কসোভোর প্রিজরেন আর মা কসোভোর জিজাকোভা।

শৈশবে তেরেসা বড় হয়েছেন একজন রাজনৈতিক বাবার সাহচর্যে। তার বয়স যখন ৮ বছর তখন তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তার মা অনেকাংশেই ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নিতে থাকেন। ছোট্ট অ্যাগনেস তখন থেকেই নিজের মনকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের জন্য তৈরি করতে থাকেন। এক্ষেত্রে মা ড্রানাফাইল বোজাঝিউ-এর সহযোগিতা তাঁকে উৎসাহ যুগিয়েছে। ১৯২৯ সাল। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ১৮ বছর বয়সে লরোটোর মিশনারীর সিস্টার হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার মা এবং বোনের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। লরেটো এ্যাবি্ব থেকে তিনি আয়ারল্যান্ডের রাথফার্মহামে যান তুলনামূলক ইংরেজি শেখার জন্য। আর এ ইংরেজি ভাষা মূলত লরোটোর সিস্টাররা ভারতীয় স্কুল শিক্ষার্থীদের শেখানোর কাজে ব্যবহার করে থাকেন। ১৯২৯ সালে তিনি ভারতে আসেন। অষ্টাদশী অ্যাগনেস আয়ারল্যান্ডের লরেটো সংঘ থেকে শিক্ষকতার মানসে পাড়ি দেন কোলকাতা। লরেটো কনভেন্ট বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকতার হাতেখড়ি। প্রথম অবস্থায় তিনি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দার্জিলিংয়ে আসেন। এখানে কাজ করার সময় স্কুল প্রাচীরের পাশে মতিঝিল বস্তির মানুষগুলোর মানবেতর জীবন যাপন তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। রোগ, শোক, জরা আর মৃত্যু তাদের নিত্যসঙ্গী। ক্লাশের ফাঁকে যখন সেই ক্লান্ত করুণ মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতো তখন গভীর বিষাদে তাঁর মন ছেয়ে যেতো।

অবশেষে ১৯৩১ সালে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করলেন। এই বছরেই ২৪ মে তিনি প্রথম ধর্মীয় বাণী প্রচার শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি প্রথম তেরেসা ডি লিসিয়্যাক্স নাম ধারণ করেন। যা মিশনারীর ধর্মগুরুদের ব্যবহৃত উপাধী। এভাবেই তার মানবসেবার সূচনা। তিনি পরিচিত হতে থাকেন মাদার তেরেসা নামে। ১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি যেনো যীশুর বাণী শুনতে পেলেন। তখন থেকেই দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করলেন।
এ যেনো পরম পিতার আহবান। নীল পাড়ের সাদা সুতি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে একে একে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’। বিংশ শতাব্দীর ঠিক মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ ১৯৫০ সালে। কালীঘাটে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নির্মল হৃদয়’ আশ্রম, যেখানে আশ্রয়হীন মুমূর্ষ নর-নারীরা অন্তিম মুহূর্তে পেলো মমতাময়ী জননীর স্নেহস্পর্শ। ১৯৫৫ সালে অনাথ শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নির্মলা শিশুভবন’। যার ফলে নতুন আশ্বাস আর আশার আলোতে ভরে উঠলো বঞ্চিত জীবন।

কলকাতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে ভারতজুড়ে, তারপর সারা পৃথিবীতে। তাই পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি মাদার। ১৯৫২ সালে যখন লোকেরা কুষ্ঠরোগীদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করত, তিনি তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতার কুষ্ঠরোগীদের পাশের দাঁড়ান। তাদের সেবার জন্য গড়ে তোলেন একটি আশ্রয় কেন্দ্র 'শান্তিনগর'। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন।

মাদার তেরেসার এ মহৎ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাঁকে দিলেন ‘পদ্মশ্রী’র সম্মান।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের পাশে। একাত্তরের ডিসেম্বরে মাদার তেরেসা খুলনা ও ঢাকার কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ওখানে তিনি দেখেন পাক সেনারা কী পশুর মতো তাণ্ডব চালিয়েছে। এসব ক্যাম্পে পাক সেনারা দিনের পর দিন বাংলাদেশী নারীদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে আসছিল। এসব দেখে ঢাকায় তিনি খোলেন 'মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ'-এর একটি শাখা। তখন বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুকে দেখা হতো ঘৃণার চোখে, তাদের ফেলে দেওয়া হতো ডাস্টবিনে। মাদার তেরেসা ওই সময় পরম মমতায় যুদ্ধ শিশুদের কোলে নিতে থাকেন। তাদের পাঠিয়ে দেন কলকাতা, ফ্রান্স ও সুইডেনে।

মাদার তেরেসা বিশ্বব্যাপী তার সেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে লাভ করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ও ১৯৮০ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ খেতাব 'ভারতরত্ন'। 

এই মহিয়সী নারী ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সনে মৃত্যুবরণ করেন। মাদার তেরেসার মৃত্যুর সময় বিশ্বের ১২৩টি রাষ্ট্রে এইচআইভি /এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মার চিকিৎসা কেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ-আশ্রম ও বিদ্যালয়সহ মিশনারিজ অব চ্যারিটির ৬১০টি কেন্দ্র চালু ছিল। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে যিনি এই ছায়াহীন রৌদ্রদগ্ধ শুষ্ক জীবনমরুতে রচনা করেছিলেন ছায়াঘন প্রেমের পঞ্চবটী।

0 comments:

Post a Comment