পপ সংগীতের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম ১৯৫৮ সনের ২৯ আগস্ট। তবে জন্মের সময় তাঁর নামের পাশে ছিল না কোনো বংশমর্যাদা। উত্তরাধিকারসূত্রে শিল্প বা সংস্কৃতির কোনো প্রেরণাও সঙ্গী ছিল না জ্যাকসনের। বরং শিকাগোর ইন্ডিয়ানায় এক কারখানা পল্লীতে অনেকটা অনাদরেই জন্ম নিয়েছিলেন জ্যাকসন পরিবারের অষ্টম সদস্য মাইকেল জ্যাকসন।
আফ্রিকান-আমেরিকান শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেয়ায় সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বহু বঞ্চনার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে হয়েছিল ক্যাথেরিন এস্থার ও জোসেফ ওয়াল্টার জো জ্যাকসনের পরিবারের সদস্যদের। তার উপর বাবার সাথে মাইকেল জ্যাকসনের সম্পর্কটা মোটেও স্বস্তিকর ছিল না। তাই ছোটবেলায় একরকম নিঃসঙ্গ আর মানসিক ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়েই সময় কাটাতে হয়েছে জ্যাকসনকে। সেই সাথে নিজের দেহাবয়ব ও মুখশ্রী নিয়েও যারপরনাই অস্বস্তিতে থাকতে হতো পরবর্তী সময়ে কিং অব পপে পরিণত হওয়া এই তারকাকে। যদিও জ্যাকসনের পরবর্তী জীবনে এই সময়ের প্রভাব যতো না প্রকট ছিল তার চাইতেও অনেক বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল সময়ের পরতে পরতে তাকে জড়িয়ে গড়ে ওঠা সংগীতের ভাণ্ডার। ফলে মানুষ জ্যাকসনের চাইতে যেন যোজন ব্যবধানেই এগিয়ে ছিলেন গায়ক জ্যাকসন।
সেই ৭২-এ প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম থেকে শুরু করে ২০০১-এ শেষ অ্যালবাম। মাঝের দীর্ঘ সংগীত জীবনে এক মাইকেল জ্যাকসনের অর্জন এতটাই বেশি যে তার জীবনীর প্রতিটি পাতাই যেন মাইকেল ভক্তদের কাছে জীবন্ত। তবু ব্রেক ড্যান্স আর মুনওয়াকিং-এর মতো নতুন নৃত্যধারার জš§ দেয়া এই নাচ-গানের প্রাণপ্রাচুর্যময় মানুষটির অব্যক্ত বেদনাও কম ছিল না। পরিণত বয়সে যিনি হয়ে উঠেছিলেন মহাতারকা, সেই মাইকেল জ্যাকসনের শৈশবটা ছিল বড় বেশি বিবর্ণ। বাবার অমানবিক শাসন আর নির্যাতনের মধ্য দিয়েই ভয়ার্ত এক শৈশব পার করেছিলেন মাইকেল। এরই মাঝে গানের প্রতি ভালোবাসা। বয়স পাঁচ পেরুতে না-পেরুতেই গলায় গান। তারপর আটে পা দিতে না দিতেই সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’ নামের ব্যান্ডদল গঠন। এই ব্যান্ডের হয়ে স্থানীয়ভাবে গান-বাজনা করতে করতেই জ্যাকসন আর তাঁর দল নজর কাড়ে সে সময়ের খ্যাতনামা সিবিএস রেকর্ডস আর ফিলাডেলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল রেকর্ডস ডিভিশনের। নতুন নামে ‘দ্য জ্যকসনস্’ পরিচয়েই কাজ শুরু করে জ্যকসনের ব্যান্ডদল। আর ক্যারিয়ারের এই প্রথমার্ধেই চারটি স্টুডিও অ্যালবাম আর একাধিক জনপ্রিয় সিঙ্গেলস উপহার দেন জ্যাকসন। সময় গড়াতে থাকে। আর সেই সাথে যেন নতুন নতুন পালক যোগ হতে থাকে কৈশোর থেকে তারুণ্যের পথে পা বাড়ানো জ্যাকসনের ক্যারিয়ারেও। ১৯৭৯ সালে ‘দ্য জ্যাকসনস্’-এর খোলস ছাড়িয়ে যেন ক্যারিয়ারের নতুন এক অধ্যায়েরই জš§ দেন মাইকেল জ্যাকসন। এ বছর মুক্তি পাওয়া তার পঞ্চম সলো ‘অফ দ্য ওয়াল’ শ্রোতাপ্রিয়তা আর বিক্রির দিক থেকে ছাড়িয়ে যায় আগের সব অ্যালবামকে। ইউকে ও ইউএস টপচার্টে ঠাঁই করে নেয়া থেকে শুরু করে কনসার্ট মাতানো কিংবা মিডিয়া পার্সোনালিটি হয়ে ওঠার যে গল্প তার অনেকাংশের জš§ও ক্যারিয়ারের এ পর্যায়েই। তবে সাফল্যের দিক থেকে জ্যাকসন তার পঞ্চম অ্যালবামকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন অডিও ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের সেরা অ্যালবাম ও তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘থ্রিলার’ দিয়ে। সবমিলিয়ে ১৯৮২ তে মুক্তি পাওয়া এই অ্যালবামটি জ্যাকসনকে ৮টি গ্র্যামি, খ্যাতি আর অর্থের বাইরেও এমন কিছু রেকর্ডের সঙ্গী করে দিয়েছিল যা অতিক্রম করার সাধ্য পরবর্তী সময়ের অনেক তারকার মাঝেও হয়ে ওঠেনি। এছাড়া কনসার্টের মধ্যমনি হয়ে ওঠা জ্যাকসন এ সময়েই তাঁর নাকের কয়েক দফা চিকিৎসা করান। মাইকেল জ্যাকসনের কল্যাণে সারা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়টি। ফলে একসময় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসেবে বহু বঞ্চনার সাক্ষী মাইকেলের মুখাবয়বেও আসে পরিবর্তন। মূলত ‘থ্রিলার’-এর পর থেকে বহুদিন ধরেই একচ্ছত্রভাবে পশ্চিমা গানের জগতকে শাসন করেন জ্যাকসন। ’৮৭, ‘৯১, ’৯৫ আর ২০০১ এ সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই একে একে মুক্তি পায় ‘ব্যাড’, ‘ডেঞ্জারাস’, ‘হিস্টোরি’ আর ‘ইনভিনসিবল’ নামে আরো চারটি স্টুডিও অ্যালবাম। এছাড়াও নানা সময়ে তাঁর বহু অর্জনকে নতুন রূপে পৌঁছে দেয়ার বাণিজ্যিক চেষ্টাও শ্রোতাদের মন জয় করে। এ সময় চলচ্চিত্রে কাজ করে কিংবা রেকর্ড ২৯টি চ্যারিটিতে টাকা দান করে যেমন তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন তেমনি তাঁর নামের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল বহু অপকর্মের সংবাদও। যদিও ভক্তদের ভালোবাসা আর তারকাখ্যাতির বাইরে দাঁড়িয়ে স্রেফ জনপ্রিয়তা আর ব্যবসায়িক সাফল্য দিয়ে মাইকেল জ্যাকসনের যে অর্জন, সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকের কাছেই অলীক।
আর তাই ২০০৯ সালের ২৫ জুন মাত্র ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া এই তারকা এখন পপ সংগীতের অবিসংবাদিত এক আইকন হিসেবেই বেঁচে আছেন অগণিত শ্রোতার হৃদয়ে।
মাইকেল জ্যাকসন
Info Post
0 comments:
Post a Comment