তার এক আবিষ্কারে বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে পৃথিবীর মানুষের জীবন। তিনি অমর বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। প্রায় দুই শতক আগে তার আবিষ্কৃত আলোর উপর চৌম্বকত্বের প্রভাব অর্থাৎ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের প্রয়োগ মানুষের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয় এই মহান বিজ্ঞানীর জন্ম একটি দরিদ্র পরিবারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা আর পারিবারিক অবস্থানও ছিল নগণ্য। তবু বিজ্ঞানের বিশেষ শাখার ওপর তার অদম্য জ্ঞান-পিপাসা ও স্পৃহার কারণে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্যরকম উচ্চতায়। মাইকেল ফ্যারাডের গবেষণার মূল বিষয় ছিল রসায়নবিজ্ঞান এবং তড়িৎ রসায়নবিজ্ঞান শাখার বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে সেফটি ল্যাম্প, যা খনি শ্রমিকরা আলোর কাজে ব্যবহার করত। এছাড়া তিনি আবিষ্কার করেছেন ক্লোরিন গ্যাসের তরলীকরণ তড়িৎ বিশ্লেষণের সূত্র। মাইকেল ফ্যারাডেই প্রস্তুত করেছেন প্রথম ডায়নামো, যার নাম দিয়েছিলেন 'ম্যাসানো ইলেকট্রিক মেশিন'।।
অমর এই বিজ্ঞানীর জন্ম ১৭৯১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও দরিদ্রতা তাকে তার কাক্সিক্ষত যাত্রাপথ থেকে দূরে সরাতে পারেনি। অর্থনৈতিক দৈন্যতায় তার বাবা জেমস লন্ডনের এক পুরনো আস্তাবলে গিয়ে সপরিবারে বাসা বাঁধলেন অর্থ উপার্জনের জন্য। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এখানেও তাদের পরিবারকে নিদারুণ অসচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। বরং আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। এরই মাঝে মাইকেল ফ্যারাডেকে তার জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু তাই বলে তার অদম্য জ্ঞান-পিপাসা কখনো থেমে থাকেনি। মাইকেল ফ্যারাডেকে উঠে আসতে হয়েছে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। বাড়ির সনি্নকটে একটি প্রাথমিক স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ আর্থিক অনটনের কারণে তাকে মাঝপথেই স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। সে সময় তার প্রতিভার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। ভবঘুরের মতো সময় কাটাত ফ্যারাডে। সেই সঙ্গে তার কাজ ছিল ছোট তিন বোনকে দেখাশোনা করা।
মাত্র তের বছর বয়সে তাকে অভাবের তাগিদে কাজে ঢুকতে হলো। জর্জ নামক এক ভদ্রলোকের বইয়ের দোকানে কাজ নিল মাইকেল ফ্যারাডে। সেখানে তার কাজ হচ্ছে পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন স্থানে বাড়ি বাড়ি ফেরি করা। সকাল থেকে তাকে এই কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ার কাজে মনোনিবেশ করতেন। এরপর তার কাজের ধরন পরিবর্তন হলো। বই বাঁধাইয়ের কাজ পেলেন। এতে আয় কমে গেল। এখানে আগের চেয়ে পরিশ্রম অনেক কম। ফলে কাজের ফাঁকে জ্ঞান অর্জনের কাজে আরও মনোনিবেশ করলেন। বিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলো বেশি আগ্রহের সঙ্গে পড়তে লাগলেন। এর মধ্যে দুইটি বই তাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করল। একটি হচ্ছে মার্শেটের লেখা কনভারসেশনস ইন কেমিস্ট্রি। অন্যটি হচ্ছে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার বিদ্যুৎ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলো।
কিছুদিনের জন্য বই বাঁধাইয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। এবার দুর্ভাগ্য যেন তাদের পরিবারে বাসা বাঁধল। অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলো। আর্থিক দৈন্যতা ও অসুস্থতার কারণে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলেন। মায়ের শারীরিক অবস্থাও ভালো ছিল না। ভাইয়ের চাকরিটা চলে গেল। আর মাইকেল ফ্যারাডে উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে বেড়াতেন। তবুও আশার কথা, কিছুদিন পরে বই বাঁধাইয়ের পুরনো চাকরিটা ফিরে পেলেন। নামকরা বিজ্ঞানী স্যার হামফ্রি ডেভি তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তখন ফ্যারাডের বয়স মাত্র ২১ বছর। একদিন স্যার হামফ্রির বক্তৃতা হবে। দোকানের এক খরিদ্দার এই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চার দিনের বক্তৃতার টিকিট দিয়ে গেল। দোকানের মালিক জর্জ বিজ্ঞান বিষয়ে ফ্যারাডের আগ্রহের কথা জানতেন। সবক'টি টিকিট তাকে দিয়ে দিলেন। বক্তৃতা শুনে তার মনের গভীরে বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। আর বই বাঁধাইয়ের কাজ নয়, বিজ্ঞান নিয়েই তিনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন।
কিন্তু কিভাবে এই সিদ্ধান্ত সফল করা যায়। রয়াল সোসাইটির সভাপতি বিজ্ঞানী স্যার হামফ্রির কাছে চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন তার মনের গভীর আকুতি ও আগ্রহের কথা। উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিজ্ঞান বিষয়ে তাকে গবেষণার কোনো সুযোগ করে দেওয়া। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে স্যার হামফ্রি ডেভির চিঠির প্রত্যুত্তর পেলেন। এই চিঠিতে স্যার ডেভির কাছ থেকে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ তাকে খুবই আলোড়িত করল। এদিকে মাইকেল ফ্যারাডের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে মুগ্ধ হলেন স্যার ডেভি। তিনি উপলব্ধি করলেন বিজ্ঞানের প্রতি মাইকেল ফ্যারাডের তীব্র আগ্রহ। তাকে সেখানে নিজের গবেষণাগারে চাকরি দিলেন। এখানে ছোট চাকরি পেলেও এই চাকরি তার জীবনে সৌভাগ্যের দ্বার খুলে দেয়। এই সুযোগই মাইকেল ফ্যারাডের আমূল পরিবর্তন আনল। ফ্যারাডের মাঝে যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল তা ক্রমেই বিকশিত হতে লাগল। দেশ ভ্রমণ ফ্যারাডের এক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভ্রমণকালীন তিনি স্যার ডেভির সহকারী হিসেবে বহু পণ্ডিত মনীষীর সানি্নধ্যে আসার সুযোগ পেলেন। স্যার ডেভি ছাড়াও এসব বিজ্ঞানীর সাহচর্যে তার জীবনে ব্যাপক সাফল্যের সূচনা ঘটল। তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ফ্রান্স, ইতালিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ইতালি ভ্রমণের সময় সাক্ষাৎ ঘটল খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ভোল্টারের সঙ্গে। তিনি তখন বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এবার ফ্যারাডে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত গবেষণার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন।
এর মধ্যেই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ল ক্রমশ। মূলত তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল রসায়ন বিজ্ঞান এবং তড়িৎ রসায়ন বিজ্ঞান। সে সময় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ পেলেও তিনি গবেষণাকে প্রাধান্য দিলেন। গবেষণার কাজে আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন। তার একটি বিখ্যাত আবিষ্কার হচ্ছে সেফটি ল্যাম্প, যা খনি শ্রমিকরা আলোর কাজে ব্যবহার করত। তিনি একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য কাঁচা লোহা তারের সাহায্যে চুম্বক শক্তিতে বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি করলেন। তার কিছুদিন পর প্রস্তুত করলেন প্রথম ডায়নামো, যার নাম দিলেন 'ম্যাসানো ইলেকট্রিক মেশিন'। ১৮৪১ সালে তিনি তার যুগান্তকারী তত্ত্ব আলোকের উপর চৌম্বকত্বের প্রভাব আবিষ্কার করলেন। আর এর ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করেন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় সমীকরণ। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ লাভ করল কোনো তারের সংযোগ ছাড়াই বেতার টেলিগ্রাফ যোগাযোগ।
ফ্যারাডে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
মেহেদী হাসান বাবু
মাইকেল ফ্যারাডে
Info Post
0 comments:
Post a Comment