Breaking News
Loading...
Thursday, October 14, 2010

১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের চিত্রা নদীর পাশে মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী এস এম সুলতান। বাবা মায়ের স্বপ্নে রঙিন ক্যানভাস আর ভাবনার দুনিয়া না থাকলেও সুলতান যেন নিজেকে মেলে ধরেছিলেন গ্রামীণ জীবনের আবহে এক আধুনিক বাসত্দবতায়।
বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। রাজমিস্ত্রি বাবার সংসারে দরিদ্রতার মাঝেও ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন সুলতান। তবে তার শিল্পী জীবন কিন্তু নাটকীয়তা পায় বয়সের অল্প গন্ডিতে। ১৯৩৩ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যয়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্কুল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় লাল মিয়া তার একটি সুন্দর ছবি আঁকলে তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়সহ সবাই মুগ্ধ হন। শুরম্ন হয় শিল্পী লাল মিয়ার রঙতুলি হাতে নতুন জীবন। মূলত সেই মুগ্ধতার হাত ধরেই পরবর্তী জীবনে শিল্পী হওয়ার বাসনায় লাল মিয়া পাড়ি জমান কলকাতায়।

কিন্তু নিজের শিৰাজীবন নিয়ে কখনই সিরিয়াস ছিলেন না সুলতান। তাই শিৰাজীবন অমাপ্ত রেখে ১৯৪৪ সালে ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এই শিল্পীপ্রাণ মানুষ। কাশ্মীরের পাহাড়ে কিছুদিন একদল আদিবাসীর সঙ্গে বসবাস করেন। ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর থেকে চলে যান সিমলায়, সেখানে তার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী হয়। এই প্রদর্শনীই তার শিল্পী জীবনের প্রথম স্বীকৃতি। তারপর পাকিসত্দানের করাচী ও লাহোর ঘুরে ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে অবস্থান করে ফিরে আসেন মাতৃভূমি নড়াইলে। ১৯৫৫ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পুরম্নলিয়ায় নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই সময়ে সুলতান তার চিত্রকর্মকে আনত্দর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরেন। ১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পল কি, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীদের ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।

পরবতর্ী সময়ে সুলতান যেন নিজের ভেতরেই এক নিভৃতচারি হয়ে উঠেন। তাই কখনও লাহোর, কখনও করাচী কিংবা কখনও নড়াইলের অজো পাঁড়া গায়েও সুলতানকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই সময় যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরী তাকে যশোর নিয়ে আসেন। ১৯৬৮ সালে যশোর-খুলনা ক্লাবে তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এনাম আহম্মেদ চৌধুরীর উদ্যোগেই ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই সুলতানের মাছিমদিয়ার বাড়িতে 'দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস' উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিল্পী জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের ছবি আঁকতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সুলতান যেন আরও যাযাবর হয়ে উঠেন। রাজধানী ঢাকাতে ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই এ দেশের সুশীল সমাজ তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। নাগরিক বোধে সুলতান যেন তার চিনত্দা এই প্রথম ছড়িয়ে দিতে পারলেন। ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে তুলির আঁচড়ে মাটির গন্ধমাখা আর ঘামে ভেজা মেহনতি মানুষের সাথে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন অনেক বিখ্যাত ছবি। এই শিল্পী ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্স আটিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে চারম্নশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে সুলতান যেন তাই এখনও এক লাল আঁচড়ের নাম।

১৯৯৪ সালে সময়ের ধারাকে পেছনে ফেলে ১০ অক্টোবর তিনি যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

1 comments: