Breaking News
Loading...
Sunday, November 28, 2010

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী পাবনা জেলার ধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে তার জন্ম। ছোট বেলায় মা-বাবাকে হারান তিনি। দুঃসহ জীবন কাটছিল তার। ধানগড়া থেকে তিনি চলে যান শাহজাদপুর। একদিন ময়মনসিংহ জেলার কল্পা গ্রামে পীরশাহ্ নাসিরুদ্দিন বাগদাদীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পুত্রস্নেহে তিনি কিশোর আব্দুল হামিদ খানকে বুকে টেনে নেন এবং নিয়ে যান আসামের জলেশ্বরে। পীর সাহেবের কাছেই শুরু হয় তার লেখাপড়া। তার মধ্যে জাগিয়ে তুললেন সুপ্ত শক্তি। তারপর আরো লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে দেন দেওবন্দে। গোটা ভারতবর্ষ তখন পরাধীনতার শৃক্সখলে বন্দী। পরাধীনতার অসহনীয় জ্বালা আব্দুল হামিদ খানের বুকেও ছড়িয়ে পড়ল। মাতৃভূমির পুণ্য মাটি থেকে ইংরেজ তাড়াবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেওবন্দ থেকে ফিরে এলেন তিনি। তখন তিনি যুবক। দেখলেন এবং উপলব্ধি করলেন যে, শুধু ইংরেজরা নয়, জমিদার-মহাজনরাও এদেশের গরিব জনগণের শত্রু। খাজনা আর ঋণ-আদায়ের নামে কৃষক-মজুরদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ করা হচ্ছে ভিটেমাটি থেকে। ধানের চাষ করতে না দিয়ে জোর করে তাদের নীল চাষে বাধ্য করা হচ্ছে। এর জন্য কোনো মুজরিও নেই, ইংরেজ আদালতে বিচারও নেই। তাদের পক্ষে কেউ কথা বলে না। চাষী-মজুরদের সেই কষ্টকর দুঃসময়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন এক অকুতোভয় যুবক। মেতে উঠলেন স্বদেশী, খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনে। সংগ্রামে চলার পথে পরিচয় ঘটে মওলানা আজাদ সুবহানী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হাসান ইমাম, আবুল কাশেম ফজলুল হক, হেকিম আজমল খান, সাইফুদ্দিন কিচলু, ওবায়দুল্লাহ্ সিন্ধি, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, মতিলাল নেহরুর মতো উপমহাদেশের সেরা সেরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। এদের মধ্যে দেশবন্ধুর প্রতি ছিল তার বিশেষ টান। ১৯১৯ সালে তিনি যোগ দেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসে। স্বদেশ ও স্বজাতিকে গভীরভাবে ভালোবাসার অপরাধে কারারুদ্ধ হন তিনি। ১৭ মাস কারাগারে থেকে তার নতুন উপলব্ধি হল যে, কংগ্রেসের মাধ্যমে কৃষক-মজুরের কোনো মুক্তি আসবে না। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। টাঙ্গাইলের কাগমারী, সিরাজগঞ্জের কাওয়াখালী, রংপুরের গাইবান্ধায় ঘটালেন কৃষকদের বিশাল সমাবেশ। বললেন, অত্যাচারী জুলুমবাজ জমিদার মহাজনদের খাজনা বন্ধ করে দাও। কৃষকরা খাজনা বন্ধ করে দিল। এই জমিদার মহাজনদের পরামর্শে ইংরেজ প্রশাসন ১৯২৬ সালে তাকে বহিষ্কার করল বাংলা থেকে। তিনি আবার পা বাড়ান আসামের পথে।

সেখানে উঠেন ধুবরীর ভাসান চরে। পরে কাগমারীতে বাধেন বসতি। সে বছরই তিনি আসামের ধুবরীর ভাসান চরে পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত কৃষকদের নিয়ে বিশাল এক সমাবেশ করেছিলেন। ভাসান চরের মওলানা হিসেবেই ভক্তরা তাকে সম্বোধন করতে থাকে পীর ভাসানী নামে।

মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মূল প্রত্যয় ছিল নিপীড়িত মেহনতি মানুষের সঙ্গে একাত্মতা আর তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি ছিল লড়াই করে অধিকার আদায় করা। এই দুই বৈশিষ্ট্যই তিনি অর্জন করেছিলেন আসামের লড়াকু দিনগুলোতে। বিশ শতকের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলার ত্রিপুরা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর থেকে ভূমিহীন কৃষকরা বাঁচার তাগিদে আসাম যেতেন এবং বৈরী প্রকৃতি ও গহিন জঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপন করতেন। তাদের শ্রমে, ঘামে আসামে কৃষি উৎপাদন বেড়েছিল কয়েকগুণ। সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়েছিল সমভাবে। তাই সরকার তাদের উৎসাহিত করত। কিন্তু বাঙালির সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকায় ভূমিপুত্র আসামিরা ভীত হয়ে পড়ে। সরকার প্রয়োগ করে লাইন প্রথা। সীমানা রেখা টেনে তার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয় পূর্ববঙ্গ থেকে গিয়ে বসতি গড়া বাঙালিদের জন্য। শুরু হয় 'বাঙাল খেদা' আন্দোলন। সহায় সম্বলহীন অভিবাসী বাঙালিদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য 'লাইন প্রথার' বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন মওলানা ভাসানী। মূলধারার রাজনীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হন তিনি। নির্বাচিত হন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। সংসদেও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন ভারতের আসাম, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেই আবর্তিত ও বিকশিত। তার রাজনীতির শুরুটা আসামে, পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে পাকিস্তানে এবং শেষ পরিণতি ঘটেছে জন্মভূমি বাংলাদেশে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের যেদিন জন্ম হয়, সেইদিন ভাসানী ছিলেন আসামের কারাগারে। নভেম্বরে মুক্তি পেয়েই চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে আজকের বাংলাদেশে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইল থেকে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ব্যবস্থাপক সভায় তার বাজেট বক্তৃতা ছিল কৃষকের পক্ষে, জমিদারি উচ্ছেদের পক্ষে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পক্ষে, ঘুষ-দুর্নীতির, মদ বিক্রির বিরুদ্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে। ১৯৪৮-এর ১৯ মার্চ সংসদে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন, 'আমরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পাট উৎপাদন করব, অথচ জুট ট্যাক্স, এমনকি রেলওয়ে ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স নিয়ে যাবে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট-আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ট্যাক্সের ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে দেওয়া হোক (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র (বাংলাদেশ সরকার) প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৫)।' ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ব্যবহার করার জন্যও দাবি করেছিলেন তিনি। তার ভূমিকা ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুখকর ছিল না। ফলে চক্রান্ত শুরু হয় তাকে সরাবার। বুঝতে পেরে মওলানা ভাসানী নিজেই ইস্তফা দিয়ে দেন। সেখানেই ইতি ঘটে তার সংসদীয় জীবনের। পথের মানুষ আবার নেমে আসেন পথে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নামকরণ হয় আওয়ামী লীগ। দল গঠন করেই আওয়াজ তোলেন সরকারের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। জনপ্রিয় দাবি নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবিতে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। ৩১০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে ২২৩ আসনে জেতে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ আসন। বাকি আসন পায় অন্যান্য দল। শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৯৫৫ সাল থেকে মওলানা ভাসানী আবার নতুন উদ্যমে শুরু করেন রাজনীতি। সে রাজনীতি গণমানুষের রাজনীতি। '৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠান করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন- যা ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন হিসেবে খ্যাত। সেই সম্মেলনে তিনি যে ভাষণ দেন বিশ্লেষণের গভীরতায় ও জাতির পথ নির্দেশনায় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, 'পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে, সামরিক, বে-সামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যা সাম্যনীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান 'আসসালামু আলাইকুম' বলিবে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলদা হইয়া যাইবে (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে '৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-২২৭)।

মওলানা ভাসানী পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম কাতারের সেনানি ছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বৈরী মনোভাবে তিনি ক্রমাগত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনাকালে ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি মানিয়া লউন। অন্যথায় জাগ্রত সমাজের মনে যদি অত্যাচার ও অবিচারের প্রতিশোধ গ্রহণস্পৃহা বদ্ধমূল হয় এবং আমাদের মৃত্যুর পর যুবসমাজ নির্যাতনে অতিষ্ঠ হইয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত সংশ্রব বর্জনের দাবি উত্থাপন করে তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই থাকিবে না (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬/০১/৫৬)। পাকিস্তানের প্রতি তার সামান্যতম যে দুর্বলতা ছিল তাও একেবারে কেটে যায় ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর জলোচ্ছ্বাসে ও ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলার মানুষের বর্ণনাতীত দুর্দশা স্বচক্ষে দেখে এবং তাদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসিন্য অনুভব করে। তারপর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি উল্কার মতো ছুটে বেড়ান আজকের বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি স্তরে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বাংলাদেশের 'সকল নেতার নেতা' বলা হয় তাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশেও নিশ্চুপ থাকতে পারেননি তিনি। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এখানেও লড়েছেন মওলানা। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষে চঞ্চল মওলানা ভাসানীর ভুখা মিছিল আর অনশনের কথা এখনো মনে আছে অনেকের। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি যে ফারাক্কা লং মার্চ করেছিলেন তা এখন ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়।

দেশ বরেণ্য নেতা এই ১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাঁকে দাফন করা হয়।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত কাজী সিরাজের আর্টিক্যাল ও উইকিপিডিয়া

0 comments:

Post a Comment