Breaking News
Loading...
Thursday, December 16, 2010

প্রায় ৫৫ বছর আগে ঢাকায় ফিল্ম নির্মাণ শুরু হয় ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি দিয়ে। এই ছবিতে তিনজন নায়িকা ছিলেন, এরা হলেন নাজমা (পিয়ারি বেগম), জহরত আরা আর পূর্ণিমা সেন গুপ্তা। ছবির পরিচালক আবদুল জব্বার খান ছিলেন ছবির নায়ক। তারই নায়িকা ছিলেন পূর্ণিমা সেন গুপ্তা। এখনকার নায়িকাদের পথিকৃত্ তো তিনিই। সেই পূর্ণিমা সেন গুপ্তার কথা ক’জনই বা মনে রেখেছেন! তবে ঢাকার ফিল্মের কথা উঠতেই পূর্ণিমা সেন গুপ্তার নামটি উঠে আসবে।
পূর্ণিমা সেন গুপ্তা মারা যান ১৯৯৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর ১৩ বছর পেরিয়ে গেল। সেদিনের দর্শকরা এখনও তার কথা মনে করেন। মনে করবেনই না কেন, তিনি যখন ফিল্মে এসেছিলেন তখন সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে ছায়াছবির তারকাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। আজ এমনটি কোথায়? আর সেদিন (১৯৫৬ সালে) ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি রিলিজের আগে ও পরে পূর্ণিমা সেন গুপ্তাকে নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তিনি যখন ফিল্মে আসেন তখন ঢাকায় ফিল্ম নির্মাণ সবেমাত্র শুরু। প্রথমদিকে কোনো বছর ছবি নির্মিত হয়েছে, আবার কোনো বছর হয়নি। যে জন্য পরবর্তী সময়ে আর কোনো ছবিতে তার নায়িকা হওয়া সম্ভব হয়নি।
পূর্ণিমা সেন গুপ্তার জন্ম ১৯৩০ সালে আসামের (অসম) গৌহাটি শহরে। শৈশবের কিছুদিন তার সেখানেই কেটেছিল। পরে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় তার পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। চট্টগ্রামে এসেই বাবা-মায়ের উত্সাহে তিনি নাচগান শেখা শুরু করেন। বয়স তখন ছয় ছিল হয়তো বা। চট্টগ্রামে কোনো ফাংশন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ণিমা সেখানে প্রায় সময়ই অংশ নিতেন। প্রথমদিকে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে খুব নাম করেন। বড়-বড় সওদাগর পূর্ণিমার নাচ দেখার জন্য রাতের পর রাত বিনিদ্র রজনী কাটাতেন তখন। সবারই অপেক্ষা ছিল কখন পূর্ণিমা স্টেজে আসবেন আর কখনই বা নাচ শুরু করবেন। নাচের পাশাপাশি এক সময় তিনি মঞ্চে অভিনয়ও শুরু করেন।
১৯৪৪ সালের কথা। ওই বছর থেকেই তিনি মঞ্চে নায়িকা হিসেবে অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। সেই সময় তিনি মলিনা দেবী, রানীবালা, উমাশশী, প্রমিলা ত্রিবেদী, সাধনা বসু, লীলা দেশাই প্রমুখ অভিনেত্রীদের ছবি দেখে দেখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, কী করে ফিল্মের নায়িকা হওয়া যায়। কলকাতা বহু দূরে, তাই ওখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় অবস্থান করেই মঞ্চে একের পর এক নাটকে অভিনয় করে গেলেন। সে সময় তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, নন্দলাল, গুনাইবিবি, বেদের মেয়ে, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাধাকৃষ্ণ, আলোমতি, ভেলুয়া সুন্দরী, কমলার বনবাস, মহুয়া, চাঁদ সওদাগর, গরিবের মেয়ে, চণ্ডীদাস প্রভৃতি। থিয়েটারের এসব নাটকে পূর্ণিমাই ছিলেন নায়িকা।
১৯৫৪ সালের কথা। ইত্তেহাদ পত্রিকায় ছাপা হলো ‘খান জামান শিগগিরই ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নায়িকার জন্য কয়েকটি মুখ চাই।’ বিজ্ঞাপন পড়ে পূর্ণিমা মনে মনে ভাবলেন, ‘এবার ফিল্মের নায়িকা হতে পারব...।’ সঙ্গে সঙ্গে খামের ভেতর ছবি ও চিঠি ভরে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় আবদুল জব্বার খানের ঠিকানায়। ছবিটা দেখে আবদুল জব্বার খান পূর্ণিমা সেন গুপ্তাকে পছন্দ করলেন। তত্ক্ষণাত্ চিঠি লিখে দিলেন দেখা করার জন্য। একদিন পূর্ণিমা সেন এসে উপস্থিত হলেন আবদুল জব্বার খানের সামনে। উপস্থিত সবাই পূর্ণিমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। এভাবেই পূর্ণিমা সেন ঢাকার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’র নায়িকা হয়ে গেলেন। প্রথম ছবির নাম রাখা হয়েছিল ‘ডাকাত’। পরে নাম পাল্টে ‘মুখ ও মুখোশ’ করা হলো।
নায়িকা হিসেবে পূর্ণিমা সেনের প্রথম ও শেষ ছবি ছিল এই ‘মুখ ও মুখোশ’। এর পরে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে ‘হাম সফর’ আর ‘সোনার কাজল’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৬২ সালে।
পূর্ণিমার জীবন কাহিনী চমকপ্রদ। ১৯৬২ সালে তিনি চিত্র প্রযোজক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নাছিরকে বিয়ে করে চিত্রজগত থেকে দূরে সরে যান। নাছিরকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পূর্ণিমা সেন গুপ্তা থেকে হলেন পারভীন বানু। ১৯৭১ সালে বড় ছেলে বাবলা মারা যাওয়ায় অনেকটা ভেঙে পড়লেন। স্বামী নাছির তাকে ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ায় সংসারের পুরো দায়িত্ব পূর্ণিমার ওপর পড়েছিল। নিজের চেষ্টায় ছেলেমেয়েদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন। তারই মেয়ে নাসরিন এক সময় ফিল্মের নায়িকা হয়েছিলেন। শেষ জীবনটা তার কেটেছিল নাসরিনের বাসায়।
একদা এ দেশে অভিনয় করার জন্য মহিলা খুঁজে পাওয়া যেত না, ঠিক তখন পুরুষরাই মহিলা সেজে নারী চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলত। সেই সন্ধিক্ষণে এক অর্থে বিদ্রোহ করেই পূর্ণিমা সেনগুপ্তা মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। অন্যদিকে ঢাকার প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ নায়িকা হিসেবে অভিনয় করে এক কিংবদন্তি সৃষ্টি করলেন ১৯৫৬ সালে। যে জন্য ঢাকার ফিল্মে নায়িকাদের পথিকৃত্ হয়ে থাকবেন এই পূর্ণিমা সেন গুপ্তা।

-লিয়াকত হোসেন খোকন

0 comments:

Post a Comment