বিচারপতি ড. রাধা বিনোদ পালের জন্ম ১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছলিমপুর গ্রামে। ১৯০৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সিয়াল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে গণিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ১৯১১-১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনা করেন। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। অতঃপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯২৪ সালে। আইন পেশায় নিয়োজিত থেকে ১৯১৩ সালে প্রণীত ভারতবর্ষের আয়কর আইনের সময়োপযোগী সংস্করণ করেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকারের আয়কর আইন-সংক্রান্ত উপদেষ্টা ও ইউনিভার্সিটি ল' কলেজের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক মনোনীত হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করেন ১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ, অক্ষশক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে নুরেমবার্গ এবং টোকিওতে দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। হিটলারের মন্ত্রিপরিষদ এবং যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিচার করা হয় নুরেমবার্গে এবং জাপানের সমরবিদ জেনারেল হিদেকি তোজোর বিচার করা হয় টোকিও ট্রাইব্যুনালে। টোকিও ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রধান বিচারপতি ছিলেন ড. রাধা বিনোদ পাল। বিচারের একপর্যায়ে রাধা বিনোদ পাল বাদে অন্য সব বিচারপতি জেনারেল তোজোকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝুলানোর সিদ্ধান্ত নেন। অন্যান্য বিচারপতির ধারণা ছিল, বিচারপতি পালও মিত্রশক্তির পক্ষে অনুগত থাকবেন। কিন্তু বিচারপতি রাধা বিনোদ পালের ৮শ' পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় মিত্রশক্তি এমনকি বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। আইনের শাসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল বিচারপতি পাল কর্তৃক পূর্ববর্তী রায়কে বিতর্কিত প্রমাণ করে যুক্তি দেন_ ক. মিত্রশক্তির তিন প্রধান কর্তৃক স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত স্তিমিতকরণে প্রথাগত অস্ত্রের অনুশীলন সম্পর্কিত ঘোষণা। খ. আন্তর্জাতিক আইনের সংযম ও নিরপেক্ষতার নীতিমালা লক্সঘন। গ. জাপানের আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত উপেক্ষা করে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী আণবিক বোমা ব্যবহার।
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলনে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দ্রুত স্থিমিতকরণে প্রচলিত অস্ত্র প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। কোন যুক্তিতে জাপানের বিরুদ্ধে আণবিক বোমা ফেলা হয়? এছাড়াও জাপান যখন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ই আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে তখন তার ওপর পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাত অমানবিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। জাপানের আত্মসমর্পণের প্রমাণ আদালতের কাছে রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমেরিকা কেন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ১২ হাজার কিলোটন উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন আণবিক বোমা ফেলে হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে যথাক্রমে ২ লাখ ১৭ হাজার ১৩৭ জন এবং ৭০ হাজার শিশু ও নারীসহ নিরীহ জনগণকে হত্যা করে। হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমার আক্রমণ ইউরোপে ক্রমাগত স্নায়ুযুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দেবে। বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল রায় হয়তোবা জেনারেল তোজোসহ ৭ জনের ফাঁসি কার্যকর করতে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, শান্তি ও আইনের শাসনের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান বেশ প্রশংসিত হয়। ড. বিনোদ পাল ভালোবেসে ফেলেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাপান একদিন অর্থনৈতিক ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ড. রাধা বিনোদ পালকে সম্মান জানাতে কুণ্ঠিত করেনি জাপানের জনগণ। জাপানে তার স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য গঠিত হয়েছে পাল ফাউন্ডেশন। আন্তর্জাতিক আইনের পণ্ডিত ড. রাধা বিনোদ পাল পরবর্তী সময়ে একাধিকবার আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের বিচারপতি ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি
0 comments:
Post a Comment