Breaking News
Loading...
Monday, January 31, 2011

মিসরের সাবেক রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ হোসনি সাইদ মোবারক ১৪ অক্টোবর, ১৯৮১ সনে মিসরের কাফর-আল মেসেলহাতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন বিচার মন্ত্রণালয়ের একজন ইন্সপেক্টর। মোবারক মিসরের জাতীয় সামরিক একাডেমী, বিমানবাহিনী একাডেমী এবং মস্কোর ফ্রুনযে জেনারেল স্টাফ একাডেমীতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার আল সাদাতের অধীনে তিনি বেশকিছু সামরিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি উপ-যুদ্ধমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৭৫ সালে মোবারক মিসরের উপ-রাষ্ট্রপতি হন।
১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর সাদাতকে হত্যা করা হলে মোবারক মিসরের রাষ্ট্রপতি হন। ক্ষমতায় এসে তিনি একটি অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন প্রকল্প শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ধরে রাখার ব্যাপারেও অনমনীয় রইলেন মোবারক। মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তির ফলে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মধ্যে আগে থেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। মোবারকের ক্ষমতা গ্রহণের পর সেটি নতুনমাত্রা পেলেও তিনি তা সামাল দেন বেশ ভালোমতোই। মোবারক বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি ইতিবাচক নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নির্বাচনে জিতলে তিনি আবার মিসরের রাষ্ট্রপতি হন।
মিসরের রাজনীতিতে মহীরুহের মতো মোবারককে হত্যা করার জন্য এ পর্যন্ত ছয়বার ভয়ঙ্কর হামলা চালানো হয়। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? প্রতিবারই কী এক ঐশ্বরিক ভাগ্যবলে বেঁচে যান মোবারক। আর বিরোধীদের ওপর চালিয়ে যেতে থাকেন দমন-নিপীড়ন। মোবারকের অধিকাংশ উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হলেও তার অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর অর্থনৈতিক নীতি অনেকটাই নমনীয় হয়। সংস্কারের নামে রাষ্ট্রের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি করে দেন তিনি। প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ার বাজারে ছেড়ে দেন। কিন্তু এরপরও মিসরজুড়ে চলতে থাকা ব্যাপক দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। ফলে অনেক সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণের পরও মিসরীয়দের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একসময়ের নীলনদ, ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যের দেশ বলে খ্যাত মিসরের অবস্থা আধুনিক বিশ্বে এখন অনেকটাই বিবর্ণ। দেশজুড়ে বেকারত্ব এখন আকাশচুম্বী। জীবনযাত্রার মানও অন্যান্য আরব দেশের তুলনায় অনেক নিচে। তবে নিরেট সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে তিনি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর যথেষ্ট আধুনিকায়ন করেন। বিশেষ করে বিমানবাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। অর্থনৈতিক সমস্যা এবং ইসলামী মৌলবাদের মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলেও মোবারক ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮৮ সালে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে জাতিসংঘ ইরাকের বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মোবারক তা সমর্থন করেন, ইরাকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরব লীগকে মত দিতে উদ্বুদ্ধ করেন, ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে প্রায় ৩৯ হাজার সেনা সরবরাহ করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন। সেজন্য তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন দেন।
১৯৯৩ সালে আবারও মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হোসনি মোবারক। বিশ্বজুড়ে তখন মৌলবাদ উত্তেজনা। মোবারক ক্ষমতায় এসেই মৌলবাদবিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করেন। ১৯৯৫ সালের জুনে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে তাকে হত্যার একটি চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পাঁচজন আততায়ীকে হত্যা করা হয় এবং বাকিরা সুদানে পালিয়ে যায়। ধারণা করা হয়, সুদান থেকেই হত্যাকাণ্ডটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
১৯৯৫ সালের নভেম্বরে সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক আগে মোবারক সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে জঙ্গি ইসলামী দলদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের বহু নেতা-কর্মীকে এর জের ধরে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, মোবারক শান্তিপ্রিয় বিরোধীদেরও নির্মূল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। নির্বাচনে মোবারকের দলের বিশাল জয় হয়। ১৯৯৯ সালে মোবারাক চতুর্থবারের মতো ৬ বছরের জন্য মিসরের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন।

২০০০-এর দশকে মোবারক চরমপন্থি ইসলামীদের দমনের ধারা অব্যাহত রাখেন এবং কেবল দুর্বল বিরোধীদেরই দল গঠনের অনুমতি দেন। তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার নিন্দা জানান। একই সময়ে দেশের মধ্যপন্থি ইসলামী দলগুলো ইসলামী শরিয়া অনুসারে দেশ চালানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত নির্বাচনের পর মিসরীয়রা নিজ দেশেও অধিকতর গণতন্ত্রের প্রত্যাশা প্রকাশ করে।
২০০৫ সালে মোবারকের চতুর্থ মেয়াদ শেষ হয়ে এলে কিছু দল সংবিধানের সংশোধন কামনা করে। ২০০৫ সালের মে মাসে সংবিধানে সংশোধন আনা হয় এবং মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি বহুদলীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোবারক ৮৫%-এরও বেশি ভোট পেয়ে পঞ্চমবারের মতো ছয় বছর মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু বিরোধী প্রার্থীরা তার বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ আনেন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম মোবারকের নিয়ন্ত্রণের ফলে তাদের প্রচারে বিঘ্ন ঘটেছে বলে দাবি করেন।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ মোবারকের উত্তরাধিকার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। শোনা গেছে নানা ধরনের কথাবার্তা। তার ছোট ছেলে গামাল মোবারকের হাতে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, এমন গুজবও লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সরকারের ভেতরের বড় অংশের প্রবল বিরোধিতার কারণে মোবারকের সে উদ্যোগ সফল হয়নি। ২০১০ সালের মার্চে জার্মানিতে মোবারকের গলব্লাডারে অস্ত্রোপচার করা হয়। আর সে সময়ই খবর আসে, মোবারক ২০১১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও নাকি অংশ নেবেন। তখন থেকেই ফুঁসে উঠতে থাকে দেশটির তরুণ প্রজন্মসহ সাধারণ জনগণ। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন আবদুল নাসের। সেই থেকে দেশটিতে সেনাবাহিনীর যে দাপট শুরু হয়েছে, তা মোবারকের শাসনামলেও বহাল রয়েছে। সেনাবাহিনীর দাপটে মিসরের রাজনীতিকরা রীতিমতো দিশাহারা। তাদের সেই অস্থিরতাই এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কায়রোসহ গোটা দেশে।

এক নজরে...

পূর্বসূরি : সুফি আবু তালিব
রাজনৈতিক দল : এনডিপি
দাম্পত্য সঙ্গী : সুজান মোবারক
সন্তান : আলা মোবারক, গামাল মোবারক
ধর্ম : ইসলাম
লিখেছেণঃ রণক ইকরাম
তথ্যসূত্র : এএফপি, উইকিপিডিয়া ও আল-জাজিরা

0 comments:

Post a Comment