Breaking News
Loading...
Saturday, October 15, 2011

অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলোকবর্তিকা হাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম বাঙালি মানবতাবাদী চিকিৎসক ও ভাষাসংগ্রামী। তিনি ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ডা. কাজী আবদুস সাত্তারের জন্ম বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামের সভ্রান্ত কাজী পরিবারে। তিনি শৈশবে খ্রীস্টান স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৩৫ সালে দিলি্লতে অবস্থিত লেডি হাডিং মেডিকেল কলেজ ফর ওম্যান থেকে এমবিবিএসে প্রথম স্থান পেয়ে অত্যন্ত সম্মানজনক পদক 'ভাইসরয়' এ ভূষিত হন। উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডনে স্কলারশিপ নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফআরসিওজি লাভ করেন।
তাঁর ছোট বোন ডা. শিরিন কাজীও বড় বোনের পথ অনুসরণ করে চিকিৎসক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। শৈশবে দুই বোনই মহাত্মা গান্ধীর সানি্নধ্যে আসার সুযোগ পান। মহাত্মা গান্ধীর পুত্র রামদাস গান্ধী ছিলেন বড় ভাই কবি কাজী আশরাফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি ও তাঁর বোন ডা. শিরিন কাজী মহাত্মা গান্ধীর সেবাগ্রামের সেবাশ্রমের (হাসপাতালে) অবৈতনিকভাবে কাজ করেন। গান্ধীজি ও তাঁর স্ত্রী কস্তুরা গান্ধী তাঁদের দু'বোনকে খুব স্নেহ করতেন। এখানে কাজ করতে করতে তাঁরা গান্ধীজির আদর্শ মনেপ্রাণে অনুসরণ করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করেন। ঘড়ির কাঁটা যেন তাঁর জীবনের নিত্যসাৰী, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার কর্মময় জীবনের প্রতিটি কাজ তিনি করে গেছেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছেন। তাদেরকে নিজেও আগ্রহ করে জটিল অপারেশন শিখিয়েছেন। ভুল হলে রাগ করতেন ঠিকই কিন্তু পথদ বাঙালী মুসলিম প্রথম মহিলা ডা. জোহরা বেগম কাজী। ইংরেজী ভাষায় কথা বলতেন। তিনি নিজেকে নিয়ে কোন গৌরব করতেন না। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে শিৰিকা হিসেবে পেয়ে গৌরব বোধ করত। তিনিই প্রথম ঢাকা মেডিক্যালে স্ত্রী রোগ ও ধাত্রী বিভাগ চালু করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। গাইনি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী রোগীদের খুঁজে এনে এই বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। তখন ঢাকা শহরের সবাই এক নামে তাঁকে লেডি হিসেবে চিনতেন এবং জানতেন। স্ত্রী রোগী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ খোলার পর তিনি সকাল বিকেল এবং মাঝে মাঝে গভীর রাতেও রোগীদের খোঁজখবর নিতে হাসপাতালে যেতেন। নার্স ও ডাক্তার তাদের যথার্থ কর্তব্য পালন করতেন কিনা তিনি নিজে প্রত্যৰ করতেন। কর্মময় জীবনে তিনি বহু গরিব ছাত্রছাত্রীকে লেখাপড়ার জন্য সাহায্য করতেন। পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট হয়ে একের পর এক উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে চিকিৎসার সেবার মানকে উন্নত করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের সভ্যতা উগ্র আধুনিকতা তাকে কখনও প্রভাবিত করতে পারেনি।
কর্মজীবনে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। সারাজীবন অতিসাধারণভাবে কাটিয়েছেন। অর্থ -প্রতিপত্তি, যশ, খ্যাতি ও স্বীকৃতি তিনি কখনও তোয়াক্কা করেননি। এই কারণেই বাংলাদেশের স্ত্রী রোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় আর ডা. জোহরা বেগম কাজী এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। আমরা তাঁর আদর্শ ও কর্মময় জীবনে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরলেই মানব সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করতে প্রেরণা যোগাবে। আর নিঃস্বার্থ দূরদর্শী চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম স্বর্ণাৰরে লেখা থাকবে আমাদের ইতিহাসের পাতায়।
মানবসেবার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তমঘা-ই পাকিস্তান, বেগম রোকেয়া পদক, একুশে পদক, বিএমএ স্বর্ণ পদকে এ মহীয়সী চিকিৎসককে বিভিন্ন সময়ে সম্মান দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকায় নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। এ মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানীর অবদান জাতির ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

0 comments:

Post a Comment