Breaking News
Loading...
Tuesday, September 25, 2012

প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থ যে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেই আবহাওয়ায় এক শ্রেণীর মানুষ তাদের সমস্ত আদর্শ ত্যাগ করে আত্মোন্নয়নে নিজস্ব ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পার্থিব উন্নতি সাধনে ব্রতী হয়। আর শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থের প্রতিকূলে যারা একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায় তারা সামগ্রিক মানবকল্যাণ ও মানব উন্নয়নের জন্য তাদের সমস্ত শক্তি, অর্থ, মেধা, শ্রম ব্যয় করে নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতি পদক্ষেপে সেখানে আসে বাধা-বিপত্তি, আসে দুঃখ-কষ্ট, অভাব, অসম্মান এবং কখনো আসে প্রাণনাশের হুমকি। খরচ হয় অর্থ-সম্পদ, শক্তি এবং সকল প্রকার আরাম আয়েশ ও সুখ নিদ্রা তাকে ত্যাগ করতে হয়।
সিঁড়ি বেয়ে ভবনের নিচে নামা অতি সহজ, প্রথমোক্ত ব্যক্তিরা এই সহজ পদ্ধতির নাম রেখেছেন উন্নতি। আর একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে যারা মানবকল্যাণে কাজ করেন তাদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চান।
যারা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য, ভোগ-বিলাসের জন্য, মানুষের কাছে নাম ও মান-সম্মান পাওয়াতে ব্যস্ত, সমস্ত সততা ও আদর্শিক চিন্তাধারাকে যারা বর্জন করেছে, আর যারা সততার আদর্শকে বুকে নিয়ে ত্যাগ করেছে, কষ্ট-দুঃখ, লাঞ্ছনা সহ্য করেছে, সারাজীবন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানবকল্যাণে কাজ করেছে- এই পৃথিবীতে এবং পরকালে তাদের পুরস্কার কখনো এক নয়।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তেমনি একজন ব্যক্তি যিনি উন্মত্ত স্বার্থের জোয়ারের বিপরীতে সাঁতার কেটে, তার মেধা, শ্রম, শক্তি ব্যয় করে, আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ত্যাগ করে তার সুনির্দিষ্ট আদর্শিক লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছিলেন। শুধু বাংলায় নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে কয়েকজন নেতা সক্রিয় ছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। ‘‘তাকে মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং জনক হিসেবে অভিহিত করা যায়।” মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে মুসলিম সাংবাদিকতার জনক বলা হয়। তার প্রতিষ্ঠিত “দৈনিক আজাদ” পাকিস্তান আন্দোলনের একমাত্র বাংলা মুখপত্র হিসেবে গণ্য ছিল। বাংলাভাষী মুসলমানদের একমাত্র সম্বল ছিল দৈনিক আজাদ।
কি কি পরিস্থিতি এবং পরিবেশের তাড়নায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার পেশা বেছে নিয়েছিলেন, শুধু তাই নয় তাঁর লেখক জীবনও যে একটা আদর্শিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সে প্রসঙ্গে পর্যায়ক্রমে এবার আলোচনা করা যাক।
তার ছিল প্রবল ঈমানী শক্তি, তার চিন্তাধারা ছিল সততা ও আদর্শের আলোকে দীপ্ত। পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের উপর তার ছিল অগাধ ভালবাসা, যেমন একজন মুমিনের থাকা উচিত। তার চিন্তা-চেতনা ও কর্মধারা প্রসঙ্গে দু’একটি বিষয়ে আলোকপাত করলে উপরোক্ত মন্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
তার রচিত “মোস্তফা চরিত” গ্রন্থে তিনি লেখেন, “জীবনে একবারও কোরআন শরীফের কোনো একটি অধ্যায় পাঠ করার সৌভাগ্য যিনি লাভ করিয়াছেন, তাহাকে স্বীকার করিতেই হইবে যে, এই শ্রেণীর গতানুগতিক ও অন্ধ বিশ্বাসের মূলোচ্ছেদ করাকেই কোরআন নিজের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত করিয়াছে। কিন্তু হইলে কি হইবে আজ মুছলমান নিজের জন্মগত ও পারিপার্শ্বিক কুসংস্কারের চাপে কোরআনের সেই স্পষ্ট শিক্ষাকে একেবারে ভুলিয়া বসিয়াছে, ভুলিয়া বসাকেই, এমনকি সেই শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করাকেই আজ তাহারা “এছলাম” বলিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে।”
“মুছলমানকে আজ আবার নতুন করিয়া শিখাইতে হইবে যে, আল্লাহ্ ও তাহার রছুল ব্যতীত যিনি যত বড় পীর-দরবেশ অলি বা আলেম হউন না কেন যুক্তি প্রমাণ ও দলিলের বিপরীত হইলে তাহার কথা মানিব না, কারণ ইহাই সম্পূর্ণ অনৈছলামিক শিক্ষা। এই শিক্ষা ও বিশ্বাসের ফলেই মুছলমানের যত সর্বনাশ হইয়াছে। এ কথাগুলি মুছলমান জনসাধারণকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে...অন্ধ বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করাই এছলামের প্রধান শিক্ষা।”
মুসলমানদের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। এই প্রসঙ্গে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, “বাঙ্গালী মুসলমানদের রাজনৈতিক জনক” প্রবন্ধে লিখেন, “মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য মাওলানা আকরম খাঁ একদিকে নিজ সমাজ এবং অন্যদিকে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ ও ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে রত ছিলেন।”
মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংগ্রামের এই যে চিন্তা-চেতনা, নিষ্ঠা সততা, আদর্শ, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ কোথায় পেয়েছিলেন এই প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। তার অসাধারণ জীবনধারা পর্যালোচনা করলে তিনটি উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়।
বংশগত শিক্ষা ও সংস্কৃতি।
পরিবেশ ও পরিস্থিতির ঘাত-প্রতিঘাত।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঠিক জ্ঞান।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর বংশের ষষ্ঠ পূর্বপুরুষ পর্যন্ত নাম জানা যায়। তাদের সকলেই ছিলেন ধার্মিক, মহৎপ্রাণ ও স্বদেশানুরাগী। তার পিতা মাওলানা বারী খাঁ আরবী ও ফার্সি ভাষায় বেশ কয়েকটি উচ্চমানের গ্রন্থ রচনা করে পন্ডিত হিসেবে পরিচিত হন। “উনিশশতকের প্রথমার্ধে পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল শিখদের অধীনে ছিল। শিখরা মুসলমানদের ধর্মকর্মে বাধা প্রদান করতো, নির্যাতন করতো। একসময় শিখরা মুসলমানদের ‘আজান’ দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।” “হোলকারদের অন্যতম প্রাক্তন সেনাপতি মাওলানা সাইয়েদ আহমদ বেরলভী [১৭৮৬-১৮৩১] প্রতিবাদস্বরূপ শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। এবং মুসলমানদের সংগঠিত করে তিনি ওয়াহাবী আন্দোলন গড়ে তোলেন।” “মাওলানা বারী খাঁ সাইয়েদ আহমদ বেরলভীর সৈন্যদলে একজন অগ্রসেনানীরূপে পরিচিতি এবং খ্যাতি অর্জন করেন।” “মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর দাদা তোরাব আলী খাঁও ছিলেন একজন সংগ্রামী পুরুষ। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি শহীদ তিতুমীরের সহযোদ্ধা হয়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে।”
মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যার পিতা ও পিতৃপুরুষরা হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি, সেই জেহাদী রক্ত যার শরীরে, ঈমানী তেজ যার অন্তরে তিনি কিভাবে নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে পারেন! বিশেষ করে তারই চোখের সামনে ধীরে ধীরে এককালের রাজা-বাদশা ও শাসকশ্রেণী মুসলমান জাতি যখন ক্ষমতা হারিয়ে চরম অধঃপতনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে!
১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তার পিতামাতা একই দিনে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তখন আকরম খাঁর বয়স মাত্র ১১ বছর। যে বয়সে সহজ-সরল কিশোররা পৃথিবীর দিকে নতুন করে তাকাতে শেখে। এ সময়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষের এই বাংলা ভূখণ্ডে নির্যাতিত শোষিত নিগৃহীত মুসলমানরা অবৈধ ও বেআইনিভাবে বঞ্চিত, তাদের দীর্ঘশ্বাসে বাংলার বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাস আরো আগে ১৭৫৭ সাল থেকে। নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের পর বৃটিশ তথা খ্রীস্টান সাম্রাজ্যবাদীরা যখন অখণ্ড ভারতের শাসক হয়ে বসে। বর্ণহিন্দুরাই প্রকারান্তরে খ্রীস্টানদের শাসকের আসন পাকাপোক্ত করে দেয়। উদ্দেশ্য ভারতের মুসলমানদের ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়া। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আদর্শিক ও সামাজিকভাবে মুসলমানদের ধ্বংস করতে করতে প্রায় দেড়শত বছর শেষে ১৯০০ সালের দিকে অখণ্ড ভারতের মুসলমানদের অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “হিন্দু রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা হিন্দু জাতীয়তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, বিশিষ্ট নেতারাও মুসলমানদের সহিত ছুৎমার্গের সীমানা পার হইয়া মিশিতে পারিতেন না। এমন কি মফস্বলে হিন্দু-মুসলমান নেতারা বক্তৃতা করিতে গিয়াছেন- হিন্দু নেতারা জলপান করিবেন বলিয়া মুসলমান ‘ভ্রাতা’কে ঘরের একটু বাহিরে যাইবার অনুরোধ করিলেন।” মুসলমান ছুঁয়ে দিলে হিন্দুদের জাত যায়, তারা অপবিত্র হয়ে যায়। তারা মুসলমানদের নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য জীবের চেয়েও জঘন্য পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। এ শিক্ষা হিন্দুদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে উৎসারিত নয়, এ শিক্ষা তাদের পরিবার থেকে আজও দেয়া হয়, এ শিক্ষা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে আজও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়ার্ত সন্ত্রস্ত এক হিন্দু পরিবারকে এক মুসলিম পরিবার আশ্রয় দেয়। অনাহারক্লিষ্ট, অসহায় ও ভয়ার্ত হিন্দু পরিবারটির জন্য মুসলিম পরিবারকর্তা অনেক কষ্ট করে খাবার জোগাড় করেছেন কিন্তু তারা তা খায়নি বরং চাউল চেয়ে নিজেরা রান্না করে খেয়েছে। রান্নার পূর্বে তারা মাটির চুলো গোবরজল দিয়ে লেপে নিচ্ছিল। গৃহকর্ত্রী প্রশ্ন করলেন, “কি হচ্ছে দিদি?” উত্তর এলো, “একটু ‘নিকিয়ে’ নিচ্ছি।” অর্থাৎ চুলাটিও তাদের কাছে অপবিত্র, আগুনে তা পবিত্র হয়নি। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৭১...প্রায় ৭১ বছর পরে এসেও মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং আজও তদ্রূপ দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। এইসব ঘৃণা, অপমান এবং জঘন্য আচরণ ছাড়াও ধর্মকর্মে বাধা প্রদান, দাড়ি-টুপিকে তাচ্ছিল্য করা এবং দাঙ্গা, খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন ও হত্যা-গুপ্তহত্যার যে চিত্র ইতিহাসে পাওয়া যায় এবং উপরোক্ত চিত্র থেকে যে পরিবেশ পরিস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বুঝা যায় “পাকিস্তান” নামে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির অতীব প্রয়োজন ছিল। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এই রকম পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র মুসলমানদের পুনর্জীবিত করার লক্ষ্যে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
হিন্দুরা এতসবেও থেমে থাকেনি, ডা. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর “হিন্দু মহাসভা” দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত “আর্যসমাজ” ইত্যাদি সংগঠনগুলো মুসলমানদের জোর করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে থাকে।
অন্যদিকে বৃটিশ উগ্র খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচার, নিষ্পেষণ কারো অজানা নয়। তদুপরি তাদের মিশনারিগুলোও মুসলমানদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে থাকে। ১৯১১ সালের আদমশুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় ১৯০১ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৭৯.৫%। “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার” পঞ্চবার্ষিক রিপোর্টে আদমশুমারির বিভিন্ন সমপ্রদায়ের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধির খতিয়ান তুলে ধরে দেখানো হয়- ১৯১১ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার মুসলমান খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছাত্র অবস্থায় লেখাপড়ার বাইরে খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। তিনি খ্রিস্টানদের ইসলাম বিরোধী মিশনারী প্রচারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং এ বিষয়ে বক্তৃতা, প্রবন্ধ ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরোধিতা করার সাথে সাথে তিনি বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও প্রচার চালান। বৃটিশদের ভারতবর্ষ থেকে উৎখাত করতে পারলে ইসলাম বিরোধী প্রচারণার অবসান হবে বলে তিনি যুক্তি দেখাতেন।
আজো মুসলমানদের উপর হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদীদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন তো হয়ইনি বরং উত্তরোত্তর তা আরো নিকৃষ্ট পর্যায়ে চলে গেছে। যদি কেউ বলেন, হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে আর তাইতো এদেশের একশ্রেণীর কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, শিল্পি ও বুদ্ধিজীবী তাদের সাথে হরিহর আত্মা হয়ে গেছেন, তাই তাদের বলা, লেখা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় শুধু হিন্দু বন্দনা, তবে তিনি ভুল বলেছেন বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে হবে। অথবা তিনি যে ব্যক্তিই হোন না কেন তিনি মুসলিম নামের ছদ্মাবরণে একজন হিন্দু ছাড়া কিছুই নয়। তিনি অবশ্যই ভণ্ড ও প্রতারক মুসলমান। অথবা মুসলিম নামের আড়ালে হিন্দুদের সন্তান, তারা নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাংবাদিক হলেও তারা হিন্দুদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আজো সেই একই রকম মুসলমান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। নইলে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ৬২ বছরের মুসলিম রক্ষার সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যায়।
মুসলমানদের প্রতি অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের বিপরীত সেদিন এই বাংলা ভূখণ্ডে ঈমানী তেজ, বীরত্ব, সততা, নিষ্ঠা এবং সাহসিকতা নিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন একে ৪৭ রাইফেল নামক ‘কলম’ মুখে ছিল মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ের আত্মত্যাগের সুর মেশানো তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ মধুর ভাষা। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। তখন তার বয়স মাত্র ৩২ বছর, কেবলমাত্র এফ.এম পরীক্ষা পাস করে [২য় বিভাগে] তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। ১৯০০ সাল। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ জ্ঞানী, শিক্ষিত, বিচক্ষণ এবং বলিষ্ঠ এক যুবক। উপরোক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তিনি তার অন্তরাত্মা, মন-মস্তিষ্ক, শিরা-উপশিরা এমনকি তার প্রতিটি লোমকূপ পর্যন্ত প্রতিবাদের কঠিনতম শপথে শাণিত করেছেন।
সেই সময়ে সেই বাংলা ভূখণ্ডে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মিলিত শোষণ ও শাসনে এবং ষড়যন্ত্রের ভয়াল রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। যতই ষড়যন্ত্র, যতই নির্যাতন শোষণ চলেছে মাওলানা আকরম খাঁর মুসলিম দরদি মন ততই মুসলমানদের উপর নিগূঢ় প্রেম-ভালোবাসায় আরো ফুলে-ফেঁপে মহাসাগরের মতো হয়েছে। ঈমান বেড়েছে, দৃঢ়তর হয়েছে কল্যাণকামী ইচ্ছাশক্তি।
বিংশ শতাব্দির প্রথমেই যে অবস্থায় মুসলমানদের পাওয়া গেল তাহলো অত্যাচারে অত্যাচারে নিকৃষ্ট রোগাক্রান্ত প্রাণীর মত। হিন্দু ও ইংরেজ খ্রিস্টানদের হিংস্রতায় ক্ষত-বিক্ষত জীবন। মুসলমানরা তখন খ্রিস্টানদের তৈরি করা হিন্দু জমিদারদের ভোগ-বিলাসের অর্থের যোগান দিতে জমিতে খেটে খাওয়া কঙ্কালসার মজুর। খ্রিস্টানরা যথার্থ মূল্যের চেয়ে কমদামে কিংবা বিনামূল্যেই ভারত থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য ও কৃষিজাত পণ্য ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে রফতানি করতো। জমিদার ও জোতদাররা খেটে খাওয়া মুসলমান মজুরদের রক্ত শুষে তাদের অর্থ উসুল করতো। “এই শোষণের তীব্রতা ১৯০০ সালেই বৃদ্ধি পেয়েছিল।”
মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ঈমানী চেতনা, নিষ্ঠা, সততা ও সাহসীকতার উৎস নির্ণয়ে মুসলমানদের উপর অবিচার ও বঞ্চনার আরো কিছু তথ্য আমাদের সামনে রাখা প্রয়োজন। মুসলিম শাসকরা তাদের শাসনকার্যের সময় সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এলাকার পর এলাকা, গ্রামের পর গ্রাম, বিস্তির্ণ ভূমি যা ছিল দুর্গম এবং বন-জঙ্গলে পূর্ণ, সে সব এলাকা মনুষ্য বসতির জন্য আবাদ করেছিল। এলাকা ও গ্রামগুলির নাম যুদ্ধে জেতা বিশিষ্ট সৈনিক ও দেশপ্রেমিক কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে নামকরণ করেছিল। হিন্দু ও খ্রিস্টানরা মুসলমানদের কাছ থেকে সেই সব জমি ও সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল ১৭৯৩ সালে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের” নামে। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে সেই আবাদী এলাকার নাম, যা ছিল মুসলিম ব্যক্তিদের নামে তা উঠিয়ে দিয়ে, মুছে ফেলে, হিন্দুরা খ্রিস্টানদের যোগসাজশে হিন্দু ও খ্রিস্টান উভয় নামেই এলাকা, প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, নদী ও গ্রাম-শহরের নামকরণ করতে থাকে। পাকিস্তান নামের ক্ষমতা পেয়েও যা মুসলমানরা পরিবর্তন করেনি।
“মুসলমানরা ছিল বহুমুখী নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। সে সময়ে বেশির ভাগ কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যদিনের পরিসর ছিল ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা।” এই বিপুল শ্রমদান করেও মুসলমানরা দু-বেলা দুইমুঠো খেতে পারতো না। দুর্ভিক্ষ লেগেই ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় কলেরা ও প্লেগ মহামারী রূপে দেখা দিত। “১৮৯৬-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে ৬০ লক্ষ মানুষ প্লেগে প্রাণ হারিয়েছিল।”
পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষের মননশীলতা, নৈতিকতা এবং গঠনশীল চিন্তাধারা তৈরিতে প্রবল ভূমিকা রাখে। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ব্যর্থ, পরাজিত, অপমানিত এবং অশিক্ষিত এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তিনি জানতেন এই জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে পৃথিবী শাসন করেছে। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সমস্ত সদগুণ এদের মাধ্যমেই আল্লাহতাআলা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর একমাত্র এদেরকেই স্বরূপে গতিময় করতে পারলেই পৃথিবী শান্তিময় হতে পারে।
তিনি প্রথমেই দৃষ্টি দেন তার চারপাশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে। যুগ যুগ ধরে অত্যাচার, নিষ্পেষণ আর বঞ্চনায় ভয়ার্ত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। চিন্তাধারা হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। মুসলিম সমাজ সর্বজনীন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারা যেন “সিজোফ্রেনিয়া” রোগী। বির্যবত্তা, সাহস, সদিচ্ছা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আর এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে হিন্দু এবং খ্রিস্টানরা। তারা মুসলমানদের মধ্যে কাদিয়ানী ফিরকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারা হাজার হাজার মুসলমানকে হিন্দু এবং খ্রিস্টান বানাচ্ছে জোর করে। এরই মধ্যে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে “মাযহাব” ফিরকা। না খেতে পাওয়া সংকীর্ণ চিন্তার দরিদ্র, বুভুক্ষ, অশিক্ষিত মুসলমানরা সেই ‘মাযহাব’ ফিরকার দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত। কোথায় হারিয়ে গেছে তাদের ক্ষমতা, বল-বীর্য, কোথায় পালিয়েছে স্বাধীনতা- সেদিকে কারো দৃষ্টি নেই, ছিল না।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর মুসলিম দরদি মন কেঁদে ওঠে বারবার। আগে ঘরের আগুন নেভাতে হবে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেভাবে হোক মিটিয়ে ফেলতে হবে, নইলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মুসলমানদের “ছাই”-এর মত পড়ে থাকা বাকি অস্তিত্বটুকুও অত্যাচারের প্লাবনে ধুয়ে মুছে যাবে। তিনি মাদরাসায় কোরআন-হাদিস পড়েই পাশ করেছেন, তিনি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গভীর মনোনিবেশ সহকারে অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে শুরু করলেন। “না” শরীয়তের মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কোথাও গুরুতর কোনো মতভেদ নেই।
মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য নতুন করে কোরআন হাদিস নিয়ে গবেষণা করাটা তার ছিল চিন্তা-চেতনা, নিষ্ঠা, সততা ও আদর্শ জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জ্ঞান ও সাহস, নীতি ও নৈতিকতা, ইচ্ছা ও ইচ্ছা পূরণের নির্দিষ্ট পথ আবিষ্কারের তৃতীয় উৎস।
এই সময়ে অন্যান্য পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি কলকাতা থেকে “বঙ্গবাসী” ও “হিতবাদী” নামে দুটি বহুল জনপ্রিয় পত্রিকা প্রকাশ হতো। এই পত্রিকাগুলোতে প্রায়শ মুসলিম সমাজ ও ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হতো। শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রধান অন্তরায় ছিল কংগ্রেসের উগ্রপন্থিদের মুসলিম বিদ্বেষ। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মুম্বাইয়ের বালগঙ্গাধর তিলক। [১৮৫৬-১৯২০।] এই বালগঙ্গাধর তিলক ছিলেন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট এবং ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন। এইসব পত্রিকায়ও মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখা হতো। “মুসলমানদের অপমান করার জন্য তিলক ইচ্ছাকৃতভাবে গণপতি উৎসবের সূচনা করেন। মহররমের অনুষ্ঠান অনুকরণ করে তিলক হিন্দু সম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন।” ‘তিলকের মুসলিম বিদ্বেষী পত্রিকা এত জনপ্রিয় হয় যে ১৯০০ সালের দিকে কলকাতায় তিলকের বামপন্থি ও ইসলাম বিরোধী সংগঠনের অনুরূপ সংগঠন গড়ে ওঠে। এমনকি ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে চরমপন্থিদের প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের সভাপতির জন্য তিলকের নাম প্রস্তাবিত হয়।”
পত্র-পত্রিকার প্রভাব সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ নিশ্চিত ছিলেন। আর হিন্দুদের পত্রিকায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হতো যাতে হিন্দুরা ইসলাম ও মুসলমানকে আরো ঘৃণা করতো এবং মুসলমানদের অনেকেই, যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কম ও ঈমান দুর্বল তারাও বিভক্ত হতো।
“এগুলো পাঠ করে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ নিজ ধর্ম ও সমাজের নিন্দায় খুবই ক্ষুণœ হন এবং এর ফলে স্বীয় সমাজের মুখপাত্র হিসেবে পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা ক্রমশ: তার মনে দৃঢ় হয়ে ওঠে।” এই সময়ে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের তেমন কোনো পত্রিকা ছিল না। তবে উর্দু ও ইংরেজীতে নরমপন্থি ধরণের হলেও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ‘আল হিলাল’, মুহম্মদ আলী ‘কমরেড’, এবং জাফর আলী ‘জমিদার’ প্রকাশ করে ঔপনিবেশিক সরকারের সমালোচনা করতেন।
পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁও তার কর্তব্য, কর্ম, করণীয় নির্ধারণ করে ফেললেন। প্রথমে ঘুমন্ত মুসলমানদের জাগ্রত করতে হবে। তাদের সুপ্ত, লুপ্ত চেতনায় আঘাত করে করে নিজেদের চেনার উপযোগী করে তুলতে হবে। ১৯০০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেই তিনি তার সারা জীবনের কর্মসূচি, পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলেন। এ জন্যে অর্থের প্রয়োজন। নেপথ্য সহযোগিতা প্রয়োজন। “ মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পত্রিকা প্রকাশের মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে গ্রামের বাড়ি গমন করেন। সেখানে তিনি খালার কাছ থেকে মাত্র ১ টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এ সামান্য অর্থ সম্বল করে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে পত্রিকা প্রকাশের উপায় খুঁজতে থাকেন।” আসলে কোনো সর্বজনীন আদর্শিক চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একমাত্র ঈমানী শক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞান-বুদ্ধি, শ্রম দেবার একান্ত ইচ্ছা, সততা, নিষ্ঠা ও সেই বিশেষ কাজটার প্রতি অসীম ভালোবাসা। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ চাকরি নিলেন। “আহলে হাদিস” শীর্ষক একটি সাপ্তাহিকীর মাধ্যমে তিনি প্রথম সাংবাদিক জীবনে প্রবেশ করেন। এরপর “মুহাম্মাদি আখবার” পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। কিন্তু এ চাকরিতে বৃহত্তর কল্যাণ সাধন যেমন সম্ভব নয় তেমনি নিজের লক্ষ্যে পৌছানোও সম্ভব নয়। নিজের মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশ করা দরকার, যেখানে তিনি এমন কিছু তুলে ধরবেন যাতে অলস মুসলমান সচল হয়ে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে জাগ্রত হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞানে-গুণে মুসলমানরা যেন পূর্বের সোনালি যুগের সেই শ্রেষ্ঠ মানুষের পর্যায়ে উন্নীত হয়, মানব উন্নয়ন সাধিত হয়- এই ছিল মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর বাস্তব চিন্তা এবং স্বপ্ন।
সেই ১১ বছর বয়সে একই সঙ্গে বাপ-মার মৃত্যুর পর তিনি জীবনের আরো ২১টি বছর পার করে এসেছেন- একদিকে মাদরাসার ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা, অন্যদিকে বাপ-দাদাদের জিহাদী রক্তের তেজ ও পারিপার্শ্বিক ঘাত-প্রতিঘাত। তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেছেন মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা এবং দৈন্য। তিনি পলকে পলকে লক্ষ্য করেন মুসলমানরা জানেনা তাদের ঐতিহ্য ও উৎপত্তির উৎস কোথায়, জানেনা কেন তারা খ্রিষ্টান ও বর্ণহিন্দুদের পদানত কিংবা দেশীয় হিন্দুদের চেয়ে কতশতগুণ অনগ্রসর।

তিনি একসময় রোজগারের মাত্র ৬০ টাকা নিয়ে পত্রিকা প্রকাশে নেমে পড়েন। ১৯০৩ সালের ১৮ আগষ্ট প্রথম পত্রিকা “মোহাম্মদী”র প্রথম সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেন। একটি মাত্র সংখ্যা বের করে প্রেসমালিক আর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশে সম্মতি দেননি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। অনেক সংগ্রাম, কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও পরিশ্রমের পর মহান আল্লাহতাআলা তাঁকে সুযোগ করে দেন। হাজী আলতাফের “আলতাফী” প্রেস থেকেই তিনি ‘মোহাম্মদী’ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

আবু জাফর সম্পাদিত “ মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-তে বলা হয়েছে “আলতাফী প্রেসের” স্বত্বাধিকারী ছিলেন মাওলানা আবদুল্লাহ যিনি ধনী তেল ব্যবসায়ী এবং মাওলানা আকরম খাঁর পিতৃবন্ধু ছিলেন। যাই হোক- “তাঁর আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় প্রাণান্তকর কায়িক পরিশ্রম করে নিজের কর্তৃত্বাধীনে সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’র প্রকাশ অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করেন।” সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ছাড়াও তাঁর মালিকানায় ও সম্পাদনায় পরবর্তীতে যে সব পত্রিকা প্রকাশ করেন সেগুলো হলো যথাক্রমে- ১. দৈনিক জামানা,[১৯২০] ২. সাপ্তাহিক ও দৈনিক সেবক [১৯২১] ৩. দৈনিক মোহাম্মদী [১৯২২] ৪. মাসিক মোহাম্মদী [১৯২৭] ৫. দৈনিক আজাদ [১৯৩৬] ৬. সাপ্তাহিক কমরেড [১৯৪৬] ৭. মাসিক আল-এসলাম [১৯১৫] ইত্যাদি।

উল্লিখিত পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ শুধু যে মুসলমানদের সজাগ করেছেন, তাদের চেতনে ফিরিয়ে আনায় সাহায্য করেছেন তা নয়, মুসলিম সাংবাদিকতাকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এজন্যই দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, “তাঁকে মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং জনক হিসাবে অভিহিত করা যায়।”

“পত্রিকাগুলো প্রকাশের পাশাপাশি জোরালো লেখনী পরিচালনা করে তিনি তাঁর সমকালীন হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের জাগ্রত করেন এবং প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেন।” এসকল সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে তিনি মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পশ্চাদপদতা এবং কুসংস্কার-এর মূলে আঘাত করে তাদের সামনে সামগ্রিক উন্নতির নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হন।

সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেই মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্রথমেই ঘরের কোন্দল মিটানোর প্রয়াস চালান। তিনি ছিলেন জ্ঞানী এবং সাংবাদিকতার পাশাপাশি অর্থ বুঝে বুঝে কোরআন ও হাদীস পড়ে সে বিষয়েও বিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট “মাযহাব” কোন্দলের সময় নিজে ‘আহলে হাদিস’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মূলত তিনি তাঁর পিতার মত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তা ও দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এবং তাঁর সমর্থক ছিলেন। “যে ওহাবী আন্দোলন একসময় সমগ্র ভারতে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল মাওলানা আকরম খাঁ সেই ওহাবীদেরই একজন, তাই তিনি মোহাম্মদী এবং তাহার পত্রিকার নামও “মোহাম্মদী”।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ আসলে মুসলমান দরদী ছিলেন। তাই মুসলমানদের সংকীর্ণ চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রথম পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’কে তিনি বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতার বাহনে পরিণত করেন। ইতিপূর্বে হানাফী মাযহাবের আলেমগণ, আহলে হাদিস সম্প্রদায় সম্পর্কে যে সমালোচনা করতেন প্রধানত তার প্রত্যুত্তর দেয়াই ‘মোহাম্মদী’র উদ্দেশ্য ছিল। ফলে পত্রিকাটি পূর্বোক্ত সংকীর্ণ মতের পরিবর্তে অখন্ড মুসলিম সমাজের ঐক্য ও উন্নতি সাধনের মুখপত্রে পরিণত হয়।” আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা চর্চার পরিবেশে প্রথম পর্যায়ে মাওলানা আকরম খাঁর রাজনৈতিক চেতনা গড়ে ওঠে এবং তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯১৩ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার বিভিন্ন মাযহাবের আলেমগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এর ফলে গঠিত হয়, “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” নামক আলেম সংগঠন। এ সংগঠনের মুখপত্র হিসাবেই তিনি ১৯১৫ সালে “আল-এসলাম” নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।

প্রকৃতপক্ষে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সক্রিয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তিনি প্রথমে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ভাবতেন বৃটিশ খ্রিষ্টানরাই মুসলমানদের সকল দুর্দশার কারণ। ভারতকে বৃটিশ খ্রিষ্টানদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারলে মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি পরিবর্তন করেন। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতার বর্তমান বাস্তব আলোকে তিনি স্থির বিশ্বাসী হলেন যে হিন্দুরা স্বভাবগত কারণেই মুসলমানদের মঙ্গল চায় না। কোন মুসলমান ইসলামের সঙ্গে বেঈমানী করে যদি হিন্দুধর্মের লোকদের মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে চায়, ভালবাসে, তাদের সঙ্গে মিশতে চায় তবুও সেই মুসলমানকে হিন্দুরা অন্তরে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের সঙ্গেই দেখে থাকে। মুসলমান যতই উদার মন নিয়ে হিন্দুদেরকে আপন ভ্রাতা হিসাবে গ্রহণ করতে চাউক না কেন, হিন্দুরা তাকে কখনোই আপন ভাবে না। কারণ হয়তোবা তৌহিদ ও শিরকবাদের চিরন্তন বিপরীত মেরুতে অবস্থান। তাই মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান তাঁকে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মুসলমানদের মন-মানসিকতা থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা দূরীভূত হোক। সঠিক ইসলামী চেতনায় তারা উদ্বুদ্ধ হোক। মুসলমানরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পাক এবং জয়লাভ করুক। তিনি স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি স্বপ্ন পূরণের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেখানেই দেখতেন মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে কোন কাজ হচ্ছে, কোন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বা কোন সংগঠন হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফেলতেন। স্বপ্ন পূরণের এটাই বাস্তব পদক্ষেপ। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষাই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। এইভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন [১৯২০-২২], খিলাফত আন্দোলন [১৯২০-২২], প্রজা আন্দোলন [১৯১৪-৩৬] এবং পাকিস্তান আন্দোলনে [১৯৩৭-৪৭] সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে মুসলিম দরদী এবং বাংলাভূখন্ডের মুসলমানদেও মাযহাবী কলহ-কোন্দল দূর করে তাদের মধ্যে একতাবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে, তাদেরকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নৈতিক ও মানসিক শক্তি যোগাতে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।”

উক্ত সংগঠনগুলিতে তিনি শুধু নিজেকে যুক্ত করেননি বরং নেতৃত্ব দান করেছেন। মুসলিম সমাজকে অন্ধকার ও কুসংস্কার থেকে উদ্ধার করে সত্যিকার আলোকময় ইসলামী পথের পথিক করতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান ও সমাজ হিতৈষী আলেমশ্রেণীকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন, “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”। তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। সে সময় খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণে মুসলমানরা আত্মকেন্দ্রিক, সংকীর্ণ চিন্তাধারা এবং কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। কঠিন চাপে বস্তু যেমন বিকৃত হয়ে যায়, তেমনি মুসলমানদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গিয়েছিল বিকৃত। বিভিন্ন ধরণের অনৈসলামিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে মুসলিম সমাজ ইসলাম থেকে তো দূরে সরেছিলই উপরন্তু চরম অধ:পাতে পৌছেছিল। সত্যিকার ইসলামী জ্ঞান ও আধুনিক পৃথিবীর কোন ধ্যান-ধারণা তাদের ছিল না। অন্যদিকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যাদানকারী, অজ্ঞ, সংকীর্ণমনা আলেমদের খপ্পরে পড়ে মুসলমানরা ধীরে ধীরে সমাজের নিম্মশ্রেণীর মানবগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ যখন তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং নারী-শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেন এবং প্রভূত সফলতা অর্জন করেন তখন ‘অজ্ঞ আলেম’ শ্রেণী “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”কে ‘কাফির’ ফতওয়া দেন। এতদসত্ত্বেও মাওলানা আকরম খাঁর অবিরাম প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছরের মধ্যে সংগঠনটি ১৩ জন বেতনভোগী ও ১৪ জন অবৈতনিক “মুবাল্লেগ” [ধর্ম প্রচারক] নিয়োজিত করতে সক্ষম হয়।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ যখন তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং নারী-শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেন এবং প্রভূত সফলতা অর্জন করেন তখন ‘অজ্ঞ আলেম’ শ্রেণী “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”কে ‘কাফির’ ফতওয়া দেন। এতদসত্ত্বেও মাওলানা আকরম খাঁর অবিরাম প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছরের মধ্যে সংগঠনটি ১৩ জন বেতনভোগী ও ১৪ জন অবৈতনিক “মুবাল্লেগ” [ধর্ম প্রচারক] নিয়োজিত করতে সক্ষম হয়। এই মুবাল্লেগদের অব্যাহত প্রচারের ফলে বাংলার মুসলমানগণ শুধু ধর্মীয় বিপর্যয়ের হাত থেকেই রেহাই পায়নি বরং শিক্ষা, সমাজ ও স¤প্রদায়গত স্বার্থের দিক দিয়েও উপকৃত হয়। মুবাল্লেগগণ “খাঁটি ইসলাম” প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মুসলমানদের [ক] সাধারণ শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ [খ] মামলা-মোকাদ্দমার কুফল সম্পর্কে জ্ঞানদান ও যথাসম্ভব চালু মোকাদ্দমা আপোষ করে দেয়া [গ] একতার প্রয়োজনীয়তা এবং পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের কুফল বিশদভাবে বুঝিয়ে দেয়া [ঘ] অপব্যয় ও সুদী ঋণ গ্রহণের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া [ঙ] স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রভৃতি সমাজকল্যাণমূলক দায়িত্বও পালন করতেন।

আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার প্রচেষ্টায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ঝগড়াঝাটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তাদের পারস্পরিক শতশত মোকাদ্দমার নিষ্পত্তি হয়েছে। এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যভাব এবং জাতীয়তাবোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ১৯১৭ সালে বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছুটে যান এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাদীর সহায়তায় বত্রিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দু’মাস অবধি ঘটনাস্থলে অবস্থান করে ক্ষতিগ্রস্ত, দু:স্থ মুসলমানদের মধ্যে উক্ত অর্থ বন্টন করেন। এ ছাড়াও বন্যাপীড়িতদের মধ্যে রিলিফ ঔষুধপত্র বিতরণ করে “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” জনসেবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলা ভূখন্ডে এন. জি. ও তথা খ্রিষ্টান ও হিন্দু মিশনারীরা যা করতো- মাওলানা আকরম খাঁর “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে কাজের সূচনা করে। ফলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক নব জাগরণের সূত্রপাত হয়। মুসলমানরা হিন্দু ও খ্রিষ্টান স¤প্রদায়ের সঙ্গে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিক ও নৈতিক শক্তি ফিরে পায়।

মুসলমানদের ক্ষতি হতে পারে বা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কথা ও কাজ মাওলানা আকরম খাঁ করতেন না বা বলতেন না। আর কেউ যদি মুসলমান হয়ে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতো তাকে তিনি ছাড়তেন না। পত্র-পত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে বা জনসভায় ভাষণ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি তার প্রতিবাদ করতেন। যাকে শেরে বাংলা বলা হয় সেই এ.কে ফজলুল হককেও তিনি ছাড়েননি। পূর্বে বলা হয়েছে ‘হিন্দু মহাসভা’ ‘আর্যসভা’- এসব দলগুলি ছিল প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী। ‘হিন্দু মহাসভা’ ‘আর্যসভা’ জোর করে মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতো। এই কাজটি বৈধ করার জন্য সরকারি আইনসিদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। তাই তারা প্রথমে সাংগঠনিকভাবে ব্যাপারটিকে বৈধ করার চেষ্টা করে। ‘হিন্দু মহাসভা’ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে ভারতীয় মুসলমানদের জোরপূর্বক হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার আবেদন জানিয়েছিল।

মুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মুসলমান নেতাদের প্রতিবাদের ফলে “১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অনেকমুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মুসলমান নেতাদের প্রতিবাদের ফলে “১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অনেকগুলি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়, অনুষ্ঠিত হয় গণহত্যা।” ১৯৪১ সালে এ.কে ফজলুল হক এই হিন্দু মহাসভার মত প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী ও ইসলামের চিরশত্র“র সঙ্গে একাত্ম হয়ে মুসলিম লীগ বিরোধীদের সমন্বয়ে প্রগ্রেসিভ [প্রগতিশীল] কোয়ালিশন পার্টি গঠন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৪১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলিম লীগের এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ফজলুল হকের ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ তীব্র নিন্দা করেন। বলেন, ৪০ বছর কাল মি: হক মুসলিম স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। প্রত্যেক সঙ্কটকালে তিনি শত্র“দলে যোগদান করে বাঙ্গালী মুসলমানের মুখে কালী দিয়েছেন।

অবশ্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন এবং ১৯৪১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সে স্থলে লীগ সভাপতির কাজ পরিচালনার জন্য সমস্ত ক্ষমতা মাওলানা আকরম খাঁর উপর ন্যস্ত করেন। মাওলানা আকরম খাঁ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীকেও ছাড়েননি। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। ২রা এপ্রিল মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি সর্বসম্মতিক্রমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীকে নেতা নির্বাচন করে। সোহরাওয়ার্দ্দীও এ.কে ফজলুল হকের পথ অনুসরণ করেন। তিনি কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তাঁর দৈনিক আজাদে সোহরাওয়ার্দ্দীর এই আগ্রহকে মুসলিম বাংলার প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকতার ও মন্ত্রিত্বকে নিরাপদ করার মতলব হিসাবে অভিহিত করেন। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দ্দী কয়েকজন অকংগ্রেসী ও স্বতন্ত্র মুসলমান সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।”

১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্টকে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করেন। ফলত কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধে এবং তা অচিরেই বাংলার অন্যান্য অংশ, পার্শ্ববর্তী বিহার ও মোম্বাইয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী তখন প্রাদেশিক মন্ত্রী। নোয়াখালীতে ৮৬ জন হিন্দু নিহত হয়।

“কলকাতায় হিন্দু পরিচালিত সংবাদপত্রগুলো নোয়াখালীর খবর অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে।” “সোহরাওয়ার্দ্দী সরকার সে সময় হিন্দু পরিচালিত সংবাদপত্রগুলোর অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশনের উপর কোন বিধি নিষেধ আরোপ করেনি।” পক্ষান্তরে “মুসলিম সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ প্রকাশে বিধি নিষেধ আরোপ করে।”ফলে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করেই চলেছে, এই খবরটাই দেশে বিদেশে প্রচার হতে থাকে। এতে হিন্দুরা আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং মুসলমান নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। তখন বিহারে হাজার হাজার মুসলমান অত্যন্ত অমানবিক ও নিষ্ঠুরপন্থায় নিহত হয়।

সোহরাওয়ার্দ্দীর এই মুসলিম হত্যা এবং উল্টো মুসলিমদেরকে হত্যাকারী এবং দাঙ্গাবাজ হিসাবে কলঙ্ক লেপনের কৌশল দেখে মুসলিম বিবেক শিউরে ওঠে। মুসলিম দরদী, বাংলার মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে, মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত কৌশল অবলম্বন করায় তাঁর লেখনী প্রতিবাদ করে ওঠে- “আমি মনে করি মোছলেম বিহারের এই বিপদের জন্য প্রথম অপরাধী হইতেছেন বাংলার মোছলেম লীগ গবর্ণমেন্ট ও তাহার একমাত্র স্বত্বাধিকারী মি: হোছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী।”

বর্ণিত দাঙ্গা ঘটানোর অপরাধে বহু মুসলমানকে সোহরাওয়ার্দ্দী গ্রেফতার করেছিলেন। সেজন্য ঐ সময়ে সোহরাওয়ার্দ্দী এবং আবুল হাশিম মুসলিম লীগের মূল স্রোত থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সোহরাওয়ার্দ্দীওর øেহধন্য আবুল হাশিম ছিলেন বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগ সভাপতি। ১৯৪৩ সালে ৬ নভেম্বর দলীয় নির্বাচনে তিনি দলের প্রাদেশিক সেক্রেটারী নির্বচিত হন। প্রথমদিকে হিন্দুয়ানী বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীতে মুসলিম বাংলার সংস্কৃতির সমর্থক হন এবং ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।

কুমিল্লায় দাঙ্গা ঘটানোর অপরাধে [!] “সোহরাওয়ার্দ্দী সরকার বহু মুসলমানকে গ্রেফতার করেছিল। মাওলানা আকরম খাঁ সেই সব হতভাগ্য নিরপরাধ মুসলমানদের জেল থেকে মুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা তদবীর করেন। দাঙ্গায় বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ সালে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে একটি সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন কালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, “আল্লাহর নামে এই পতাকা উত্তোলন করছি। ভারতের দশকোটি মুসলমানের ইজ্জত এর সঙ্গে জড়িত, শির গেলেও ইজ্জত যেন না যায়, এটাই আমাদের সংকল্প। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “ইসলামের জন্য মুসলমান জাতির জন্য যা কিছু করার দরকার তা কোরবানী করার সংকল্প আমাদের গ্রহণ করতে হবে।...মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার আদায় করা সম্ভবপর হবে ভালবাসার দ্বারা অন্যথায় প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগে অর্জন করতে হবে।”

উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলমানদের পক্ষে যে অকল্পনীয় লড়াই চালিয়ে গেছেন তা এককথায বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তিনি জয়ী হয়েছিলেন সে লড়াইয়ে, তাই আজো বাঙ্গালী মুসলমান যারা ইসলামী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী তারা বাঙ্গালা এবং নামধারী মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জযলাভ করে টিকে আছে। হয়তো বা যখন একজন সত্যিকার মুসলিম নেতার অভাবে এ দেশের বাঙ্গালী মুসলমান-বাঙ্গালী হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে এতদিনে হারিয়ে যেতো।

১৯৪৭ সালে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি হিসাবে “পূর্ব-পাকিস্তানের” স্বাধীনতা শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী ও আবুল হাশিম চাননি। যদিও দু’জনেই ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। সে সময় সোহরাওয়ার্দ্দী ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। অখন্ড বাংলা খন্ডিত হয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র “পূর্ব পাকিস্তান” হোক উক্ত নেতৃদ্বয় তা চাননি, তারা চেয়েছিলেন পুরো বাংলা ভূখন্ড পৃথকভাবে স্বাধীন হোক। 

সিরাজুদ্দীন হোসেন “ইতিহাস কথা কও” গ্রন্থে লিখেছেন, “১৯৪৭ সালের ৯ এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীও হিন্দু নেতৃবৃন্দের বঙ্গভঙ্গের দাবির বিরোধিতা করেন।” অর্থাৎ কিছু হিন্দু নেতা চেয়েছিলেন বঙ্গদেশ ভাগ হয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন হোক। সিরাজুদ্দীন হোসেন আরো লিখেছেন, “২৭ এপ্রিল বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার কথা না বলে তিনি (সোহরাওয়ার্দী) বাংলার জন্য অবিভক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দাবি করেন।”
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বঙ্গভঙ্গ হোক এটা প্রথমদিকে জিন্নাহও চাননি। তিনি অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মাওলানা আকরম খাঁরও সেই অভিমত ছিল। কিন্তু “মাউন্টব্যাটন পরিকল্পনা” পুরোপুরি গ্রহণ কিংবা বর্জনের প্রশ্ন দেখা দিলে বাংলা সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।
সোহরাওয়ার্দী কয়েকজন হিন্দু নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্বাধীন বঙ্গভূমির দাবি করেন। সেইসব হিন্দু নেতাদের অন্যতম হলেন শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমুখ। তারা স্বাধীন বঙ্গভূমির জন্য নানাবিধ পরিকল্পনাও পেশ করেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯৪৭ সালের ১৪ মে তাদের পরিকল্পনার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন- “বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে মি. শরৎ চন্দ্র বসুর নয় দফা সম্বলিত ফর্মূলাটি বাংলার মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রামকে চিরতরে সমাধিস্ত করিবার জন্যই রচিত হইয়াছে।”
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলমানদের স্বার্থ বিবেচনা করেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ছিলেন। তার ধারণা ছিল দীর্ঘ শোষণ, শাসন, বঞ্চনা ও নির্যাতনের পর কেবলমাত্র মুসলমানের চেতনা জাগ্রত হচ্ছে, তাদের আলস্যতা কেটে যাচ্ছে, তারা নিজেদের চিনতে শিখছে- হয়তো বা আবার তারা ভারতবর্ষে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে পারবে, এই মুহূর্তে বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানদের স্বার্থে বিরাট আঘাত পড়বে। তাছাড়া মুসলমানরা কেবল সংঘবদ্ধ হতে শিখছে, এই স্রোতেও ভাটা পড়বে। বাংলা ভাগ হলে দুই বাংলার মুসলমানদের মধ্যেও একটা বিভাজন হয়ে যাবে। ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল ধরলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি উক্ত সময়ে সাংবাদিকতার পাশাপাশি শুধুমাত্র মুসলমানদের স্বার্থরায় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করার আরো কারণ ছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি নিজে কিছুটা কৈফিয়ত দিয়েছেন, “তখন পূর্ব-বঙ্গের মুসলমান নেতাদিগকে আশ্বাস দেয়া হইয়াছিল, নতুন ব্যবস্থায় পূর্ববঙ্গ একটা মুসলমান প্রদেশে পরিণত হইবে, ইহাতে ঐ অঞ্চলের মুসলমানদিগের সুখের অবধি থাকিবে না। হিন্দুরা এই জন্যই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করিতেছে। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তাহারা তখন ভাবিয়া দেখে নাই যে বিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদিগের তুলনায় পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদিগকে অধিকতর তিগ্রস্ত হইতে হইবে।”
মোটকথা মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর সমস্ত চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, তার প্রেম-ভালোবাসা, টান ও আকর্ষণ- সবকিছুই ছিল মুসলমানদের কল্যাণের জন্য নিবেদিত। তাইতো তিনি একজন কংগ্রেসী হয়েও শুধুমাত্র মুসলমানদের প্রতি আন্তরিক টান উপলব্ধি করেই ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ সমর্থনকারী মুসলিম লীগের শিা সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আমরা দেখতে পাই, যে সমস্ত নেতৃবর্গ মুসলিম স্বার্থে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম তাদের “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” বলে অভিহিত করছেন এবং মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করে তাদের বলছেন কমিউনিস্ট ও কাদিয়ানী, এবং এই বলে প্রচারও করছেন।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে গ্রামে-গঞ্জে প্রজা তথা কৃষকশ্রেণী একতাবদ্ধ হতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন স্থানে সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। এইসব সমিতির মাধ্যমে প্রজারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে জমিদারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করে।
সাপ্তাহিক মুহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার কৃষক-প্রজাদের দাবি-দাওয়া এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা জনসমে তুলে ধরেন। তার লেখনী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে সম হয়। এভাবে সাংবাদিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মাওলানা আকরম খাঁ প্রথমে “প্রজা দরদি” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং পরে তিনি সরাসরি প্রজা-আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এর ফসল ঘরে তোলেন এ.কে ফজলুল হক। ১৯১৭ সালে এ.কে ফজলুল হক প্রজা-সমিতি গঠন করেন। পূর্ব থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমে মাওলানা আকরম খাঁ জড়িত থাকলেও ১৯২৯ সালে চূড়ান্তভাবে তিনি প্রজা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়ে তিনি হিন্দু নেতাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
১৯৩৬ সালে দুটি ঘটনা ঘটে। ১. ফজলুল হকের নেতৃত্বে “প্রজা-সমিতি” “কৃষক-প্রজা” পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। ফজলুল হকের সঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এ পর্যায়ে আকরম খাঁ কিছু অনুসারীসহ কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে কমিউনিজমের অভিযোগ উত্থাপন করে নিজস্ব উদ্যোগে প্রজাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯২৬-২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের চরম শত্র“ মনোভাবাপন্ন বালগঙ্গাধর তিলক-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি তথা “শ্রমিক ও কৃষক পার্টি” কলকাতায় গঠিত হয়। ১৯৩৬ সালের দিকে এসে কমিউনিস্টদের বিপ্লবে সারা ভারতে এক জোয়ার সৃষ্টি হয়।
তাই সঙ্গত কারণেই মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ এ.কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কমিউনিজমের অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি বিচার করেছিলেন মুসলিম ও মুসলিম বিরোধী চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
১৯৩৬ সালের দ্বিতীয় ঘটনা হলো- এই বছরের আগস্ট মাসে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ কলকাতায় আগমন করেন। আর এ সময় তার প্রচেষ্টায় মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান নেতা বাংলায় মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হন। ১৯৩৭-এ এসে মুসলিম লীগ বাংলা ভূখণ্ডে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। আর এবছরের ১৫ অক্টোবর লèৌতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগে যোগ দেন।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সারাজীবন মুসলমানদের স্বার্থরায় সংগ্রাম করে গেছেন। মুসলমানদের প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজে কখনো সরকারি মতা চাননি। চাননি মন্ত্রিত্ব। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন মুসলমানদের অন্যতম সংগঠক এবং আল্লাহ ও তার রসূলের সঠিক পথ-প্রদর্শক মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর পর দ্বিতীয় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। মাওলানা আকরম খাঁ ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করেন, “মন্ত্রী সাজার সাধ বা বাসনা আমার কোনোকালে ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকিবে না বলিয়াই বিশ্বাস করি।” উক্ত ঘোষণার পূর্বে বা পরে তিনি কখনো সরকারি মতা গ্রহণ করেননি।
মুসলমান ও ইসলামকে ভালোবেসে চির সংগ্রামী মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ মাওলানা আবুল আলা মওদূদীকেও ভালোবেসেছিলেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালের দিকে একবার বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ইসলামী রাজনীতিবিদ ও মুসলিম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম রাজনৈতিক কারণে প্রায় নব্বই বছর বয়সের মাওলানা আকরম খাঁর সাথে সাাত করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, “তুমি তো নিশ্চয়ই জানো যে আমি মাওলানা মওদূদীকে কত ভালোবাসি।... সর্বত্র কমিউনিস্টরা তাদের আদর্শের জন্য যেমন নিষ্ঠার সাথে কর্মতৎপর, ইসলামের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে তেমনি তৎপর দেখে আমি অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করি। ইসলামের জন্য আর কোনো সংগঠনকে এ সুন্দর কর্মপদ্ধতিটি অবলম্বন করতে দেখি না।”
১৯৫৬ সালে ২৬ জানুয়ারি মাওলানা মওদূদী ঢাকায় এলে মুসলিম লীগের কঠোর সমালোচনার মুখেও তিনি বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে সরকারবিরোধী এক দলের নেতাকে সম্বর্ধনা জানাতে তার যাওয়া উচিত হয়নি বলে নেতারা সমালোচনা করেন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমকে তখন বলেছিলেন, “মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানাতে না গেলে পূর্ব-পাকিস্তানি মুসলিম নেতা হিসাবে আল্লাহর নিকট কৈফিয়ত দেবার আশঙ্কায় আমি গিয়েছি। ওরা মাওলানার মর্যাদা জানে না।”
এই হলো মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ। মুসলমানদের নেতা, মুসলিম জাগরণের নেতা। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা নিগৃহীত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও অধঃপতিত মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের বেঁচে থাকার জন্য একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেছিলেন এবং অবশেষে তাদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান এনে দিয়েছিলেন, সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সুকৌশলে এবং পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। অন্যদিকে মুসলিম জাতির জাতিগত স্বার্থকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সত্তার কাছাকাছি অথবা কখনো কখনো একান্ত তথাকথিত “বাঙালি জাতিসত্তার” ধ্বজাধারী নেতৃত্বকে বাংলাদেশের মুসলিম জাতির ইতিহাসে জাতীয় নেতৃত্ব হিসেবে পূজা দেয়া হচ্ছে এবং চিরস্থায়ী করার অবিরাম প্রচেষ্টা চলছে।
মুসলমানদের নাম ব্যবহার করে কথায় কথায় “আলহামদুলিল্লাহ” “স্লামুআলাইকুম” ও “বিসমিল্লাহ” বলে, ধর্মকে হাতিয়ার করে বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ সহজ সরল মুসলমানকে অন্ধকারে রেখে যুগ যুগ ধরে তাদের নেতা সেজে বসেছে যারা তারাই মুসলিম জাগরণের অন্যতম নেতা মুনশী মেহেরুল্লা, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী, শেখ জমিরুদ্দীন ছাড়াও এমন কি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আফজল চৌধুরী, জামেদ আলী, কবি গোলাম মোহাহাম্মদ, শাহাবুদ্দীন আহম্মদ, আব্দুল মান্নান তালিব, আব্দুল মন্নান সৈয়দ, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মত কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিককে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলছে। বিশ্ব মুসলমানদের গৌরব মহাকবি ইকবালকে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে বাংলাদেশের নামধারী মুসলিম নেতৃত্ব মুছে ফেলেছে।
যে পাকিস্তান না হলে মুসলমানরা পেশাগত জীবনে ঝাড়–দার, মেথর, পিয়ন এবং চাকর-বাকর হয়েও বেঁচে থাকতে পারতো কিনা সন্দেহ- সেই পাকিস্তানের কারণেই আজ বাংলাদেশ সম্ভব হয়েছে এবং মুসলমান তাদের জাতিসত্তা নিয়ে স্বাধীন হয়ে বেঁচে আছে, সেই পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহকে ঘৃণ্য করে তোলা হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে। তাদের বৃহত্তর কর্মকে সংকীর্ণতার পর্যায়ে ফেলে ভুল ও মিথ্যে ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে, মুসলমান এবং ইসলাম এত সংকীর্ণ চিন্তার একটা ধর্ম যে, এ ধর্মের কোনো ব্যক্তি বড় কিছু করতে পারে না। যা-ও দু’একজনের নাম আসে তারা অত্যন্ত ঘৃণ্য পর্যায়ের। (যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম অর্থনৈতিক শোষণ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চণার হাত থেকে রা পেয়ে একটা স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য, কিন্তু ইসলামের চিরশত্র“রা সেই মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধর্ম যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তথা মুসলমান ও ইসলামকে কলঙ্কিত করতে চায়।)
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁকে নিয়ে স্কুল কলেজের বইতে কিছু নেই, তাকে নিয়ে মিডিয়াতে কোনো প্রোগ্রাম হয়নি, হয় না। তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো হল বা কোনো শহরে কোনো রাস্তা হয়নি। কারণ তিনি বাঙালি মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন। তিনি নাকি সাম্প্রদায়িক নেতা।
(প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য কবিতা, গান, সাহিত্য এবং ইতিহাসে মুসলমানদের পে লেখালেখি করলে বা বক্তৃতা মঞ্চে মুসলমানদের পে কথা বললে তারা হয়ে যান সাম্প্রদায়িক। এমনকি দাঙ্গার নামে মুসলমানদের যখন হত্যা করা হয় সেই ইতিহাসও যদি এখন কেউ লেখেন তবে সেই ইতিহাসবিদকেও সাম্প্রদায়িক বলা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে ‘কারা বলেন’! যারা বলেন তারা বেশিরভাগই মুসলমান। অর্থাৎ নামে মুসলমান। কিন্তু আদতে তারা নাস্তিক কমিউনিস্ট কিন্তু হিন্দুত্বে বিশ্বাসী। এদের চিহ্নিত করা হয়নি বলে দীর্ঘকালব্যাপী মুসলিম নাম নিয়ে মুসলিম সমাজে বসবাস করে প্রতারণার মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে এরা কলঙ্কিত করে আসছে এবং প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে তাদের উদ্দেশ্য প্রশাসনিকভাবে সফল করে যাচ্ছে।)
হিন্দুরা লড়েছে হিন্দু জাতিসত্তার স্বার্থরায় অথচ তাদের এই দুষ্টুচক্র সাম্প্রদায়িক বলে না। মাওলানা আকরম খাঁ সত্যের পে লড়েছিলেন তাই তিনি সাম্প্রদায়িক। তিনি এই মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য জেল খেটেছেন। ১৯২১ সালে ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের বিচার প্রহসনে মাওলানা আকরম খাঁর এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ রাখা হয়।
তার পত্রিকা দৈনিক ‘সেবক’ তখনকার সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর জামানত বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

তিনি খ্রিস্টানদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অসহযোগ আন্দোলন করেছেন। তিনি নিজে বিলেতি কাপড় বর্জন করেন এবং দেশীয় খদ্দরের তৈরি সাদা লুঙ্গি কোর্তা ও টুপি পরতে থাকেন। এছাড়া ‘স্বদেশী খেলাফত স্টোরস লি.’-নামক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মুসলমানদের তিনি খেলার মাঠেও সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানদের তিনি ভালোবাসতেন বলে বাংলা ভূখণ্ডে বসে তুর্কী খেলাফত রায়, তিনি খেলাফত আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
তিনি ছিলেন এক অসামান্য সাহিত্যিক। কবিতা চর্চাও করেছেন তিনি। অন্যদিকে তিনি একজন গবেষকের কাজও করেছেন। তার রচিত ১৪টি গ্রন্থের তালিকা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ‘মোস্তাফা চরিত, উপক্রম ও ইতিহাস ভাগ, মোছলেম বঙ্গের ইতিহাস, বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খৃস্টান ধর্ম’ অন্যতম। তার রচিত প্রবন্ধ অসংখ্য, যার সবগুলিই গবেষণামূলক। তার রচিত একটি কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। “ইয়া মোহাম্মদ আন্তা রাসূলুল্লাহ” শিরোনামের কবিতাটি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়েছিল।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ চর্চা আজও মুসলিম জাগরণের একটা উপায় হিসেবে একান্ত জরুরি। তার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে এই অসাধারণ সংগ্রামী মুসলিম জাগরণের নেতার আদর্শে জাতিকে উদ্দীপ্ত করার প্রেরণা দেয়া সম্ভব। হিন্দুজাতিসত্তার অনুসারী তথাকথিত নামধারী মুসলিম বাঙালি জাতিসত্তার কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ চর্চা করার চেয়ে মুসলিম জাতিসত্তার মুসলমান কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ চর্চা বাংলাদেশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। যাতে বাঙালি মুসলমানরা তাদের সাহিত্যÑসংস্কৃতির মর্যাদা এবং মূল্যমান সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে মাওলানা আকরম খাঁসহ অন্যান্য মুসলিম প্রতিভা সৃজনশীল চিন্তার পথ নির্দেশনায় অত্যন্ত সহায়ক হবে।
এত বছর ধরে এবং আজো সাহিত্য সংস্কৃতির েেত্র, রাজনীতির একটা বিশাল অঙ্গ জুড়ে এদেশের মুসলিম শ্রেণীর সামনে সেইসব ব্যক্তিত্বকে ও নেতৃত্বকে মর্যাদার আসনে স্থায়ী করা হয়েছে যারা বাঙালি হিন্দু, খ্রিস্টান অথবা কাদিয়ানী জাতিসত্তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাদের অনুসারী ও পূজারীরা সুকৌশলে বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার মাঝে সূক্ষ্মভাবে [বর্তমানে বড় স্থূলভাবে] তাদের রচিত সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের বক্তব্য, তাদের চিন্তা চেতনা ইত্যাদি প্রবেশ করিয়ে সহজ-সরল মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদা ও সম্মানকে দুর্বল এবং ধ্বংস করে দেবার চেষ্টায় রত। ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইসলামের উপরেই মুসলমানদের প্তি করে তুলছে। ভয়াবহ এক কৌশল তারা অবলম্বন করেছে- তা হলো তারা মুসলমানী নাম রাখে, কেউ কেউ দাড়ি রাখে ও নামাজ রোজার ভানও করে। এটা প্রতারণা ও ভণ্ডামী ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা জঘন্য অপরাধ।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ চর্চা- ঐ সব ভণ্ড ও প্রতারকদের মুখোশ খুলে দিতে পারে। এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণার জন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে।
১৯৩৭-৪৭ সালে মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। এই সময়ে তার নেতৃত্বে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বাংলার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার ল্েয পরিচালিত করতে সম হয়।
এক সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার জটিল এবং চতুর্মুখী শত্র“তার রাজনীতিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব রায় যে ভূমিকা রাখেন তা অবিসংবাদিত। ঘুমন্ত, কুসংস্কারে আবদ্ধ, নিঃশেষ প্রায় জাতির মাজহাবি কলহ-কোন্দল দূর করে তাদের জাগ্রত করা, উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করা, সঠিক পথ-প্রদর্শন করা, চেতনে ফিরিয়ে এনে একতাবদ্ধ করা, রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার মতো মানসিক ও নৈতিক শক্তি জোগাতে মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর ভূমিকা এক পথিকৃতের ভূমিকা ছিল। রাজনীতির জটিল আবর্তে বসবাস করেও তার লেখনী মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছে। দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
একদিকে খ্রিস্টানদের শোষণ শাসন ও দমননীতি- অন্যদিকে জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার ও নিষ্পেষণ আর বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নিগৃহীত মুসলমান সমাজকে ভারত বিভাগপূর্ব প্রায় ২৫ বছর বর্ণ হিন্দুদের প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপ হিসেবে আবির্ভূত করে এবং মুসলমানরা তাদের একটা সম্মানিত জীবন অর্জন করে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয় তখন তার বয়স প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলীম লীগের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন এবং এই সংগঠনের আদর্শ অনুসরণ করে পাকিস্তানের সংহতির নামে রাজনৈতিক তৎপরতায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। ১৯৬৮ সালে ১৮ আগস্ট ১০০ বছর বয়সে অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে তার সংগ্রামময় কর্মজীবনের অবসান ঘটে। 

শেখ আবুল কাসেম মিঠুন

0 comments:

Post a Comment