Breaking News
Loading...
Tuesday, April 9, 2013

জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব। তার সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। তিনি হচ্ছেন নেপালের প্রয়াত রাজা মহেন্দ্র ও রানী ইন্দিরার মেজ ছেলে এবং প্রয়াত রাজা বীরেন্দ্রের মেজভাই। নেপালের রাজ বংশীয় ইতিহাসে যে কয়জন রাজা বিভিন্ন কারণে বার বার আলোচনায় এসেছেন তাদের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্র অন্যতম। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই কাঠমান্ডুতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। খেলাধুলায়ও ছিলেন খুব পারদর্শী। ১৯৬৬ সালে জ্ঞানেন্দ্র ভারতের দার্জিলিং সেন্ট জোসেফ কলেজের হাই ক্যামব্রিজ শাখায় লেখাপড়া করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও পুরোপুরি সফল হন জ্ঞানেন্দ্র। ব্যক্তিত্ব ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিক্ষিত ছিলেন তিনি। এ কারণে রাজা বীরেন্দ্রের বিদেশ সফরকালে, জ্ঞানেন্দ্র ভারপ্রাপ্ত কমিটি ও রাজকীয় প্রতিনিধি পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন থেকেই রাজকার্য পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। এ ছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ভূমিকা ছিল তার। জ্ঞানেন্দ্র বিশ্ব বুনো পশু তহবিলের তৃতীয় ও চতুর্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। এ ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও ব্রিটেন ইত্যাদি দেশ সফর করেছেন। ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি স্বদেশ ও বিশ্বে বিভিন্ন রকমের পুরস্কার পেয়েছেন। এসব কারণে রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭০ সালের মে মাসে জ্ঞানেন্দ্র প্রয়াত রানী ঐশ্বর্যার ছোট বোন কোমলকে বিয়ে করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে তার ছেলে পারসকে যুবরাজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন জ্ঞানেন্দ্র। এর মধ্যে ১৯৭৫ এবং ১৯৯৪ সালে চীন সফর উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার জীবনে সব কিছু ছাপিয়ে যায় ২০০১ সাল। কারণ ২০০১ সালের ১ জুন সন্ধ্যায় নেপালের রাজপ্রাসাদে রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে, যা নেপালবাসীর মতো গোটা বিশ্ববাসীকে আজও নাড়া দেয়। রাজা বীরেন্দ্র ও রানী ঐশ্বর্যা এবং তাদের দুই ছেলেসহ রাজপরিবারের ১০ জনেরও বেশি সদস্য গুলিবর্ষণে নিহত হন। তখন থেকেই পাল্টে যেতে থাকে রাজপরিবারের ভাগ্য। অশনি সংকেত শুরু হয় নেপালের এই রাজবংশে। এরপর জ্ঞানেন্দ্র ৪ জুন নেপালের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ রাজবাংশের ১২তম রাজা হন। মূলত সেখান থেকেই তার উত্থান শুরু। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই দেশ পরিচালনায় মনোযোগী হন। দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে নিযুক্ত করেন। আবার তাদেরকেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। কারণ হিসেবে জাতীয় নির্বাচন ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে না পারাকে দায়ী করেন তিনি। এ সুযোগে নেপালের বিদ্রোহী দলগুলো একে অন্যের সঙ্গে জোট গড়তে শুরু করে। এ সময় তাদের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে যে কোনো মূল্যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সময়ের পরিক্রমায় ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে মাওবাদী ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো জ্ঞানেন্দ্রর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ২১ এপ্রিল ২৩ জন আন্দোলনকারী নিহত হলে তার সিংহাসনের ভিত নড়ে যায়। তিনি ঘোষণা দেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে নতুন করে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তার এই অভিপ্রায়ে বাদ সাধে। অবশেষে চরম নাটকীয়তা শেষে গিরিজা প্রসাদ কৈরালাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু জনগণ তা মেনে নেয়নি। পরবর্তীতে নেপালকে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে আগ্রহ দেখান। সবমিলিয়ে এক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যান রাজা জ্ঞানেন্দ্র। অবশেষে ২০০৬ সালের ১০ জুন নেপালের পার্লামেন্ট তার সর্বময় ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। এমনকি ভোট দানের ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়া হয় তার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২৭ মে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দিতে বলা হয় তাকে। তিনিও বাধ্য হয়ে রাজপ্রাসাদ পরিহার করেন। আর সেখানে সংরক্ষিত মূল্যবান ধনসম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন। এর মাধ্যমে ১৭৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত শাহ রাজতন্ত্রের যবনিকা ঘটে।

ব্যক্তিগত জীবনে জ্ঞানেন্দ্র খুব শৌখিন ও আরামপ্রিয় মানুষ। তিনি প্রকৃতি, গবেষণা এবং ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করেন। তিনি হচ্ছেন বুনো পশু অনুরাগী। ১৯৭৬ সালে তিনি বিশ্ব বুনো পশু তহবিল সংস্থার আন্তর্জাতিক সদস্য হন। ১৯৭৭ সালে তিনি নেপালের রাষ্ট্রীয় সভার সদস্য হন। ১৯৮২ সাল থেকে ২০০১ সালে তিনি রাজা মহেন্দ্র প্রকৃতি সংরক্ষণ তহবিলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি লুম্বিনি উন্নয়ন তহবিলের চেয়ারম্যান হন। নেপালের ক্ষমতাচ্যুত এই রাজা আবারও সিংহাসনে ফিরতে চান। এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকারে জ্ঞানেন্দ্র বলেন, সাত বছর আগে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছিলেন। সেই চুক্তি অনুসারে জ্ঞানেন্দ্রই নেপালের সাংবিধানিক রাজা। তবে ২০০৮ সালে সরকার রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয়। সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র বলেন, তিনি কখনোই নেপালের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাননি। তবে তিনি বড় পরিসরে একটি আনুষ্ঠানিক পদে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে জ্ঞানেন্দ্র এও বলেছেন, নেপালের মানুষ তাকে আবার সিংহাসনে আরোহণের বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখবে কি না, তা পরিষ্কার নয়। এমনকি আনুষ্ঠানিক পদেও তাকে মেনে নেবে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না। নেপালে এখনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। আর এ অস্থিতিশীলতার মধ্যেই জ্ঞানেন্দ্র নতুন করে আসার আলো দেখছেন। তার মতে, দেশটিতে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেকারত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো অগ্রগতি ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় নেপালের বহু সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

সাক্ষাৎকারে জ্ঞানেন্দ্র বলেন, কয়েক সপ্তাহের সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর ২০০৬ সালে তাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়। সেই চুক্তিতে ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্ট পুনর্বহাল, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে অনেকটাই মিডিয়ার আড়ালে চলে গেছেন সাবেক এই রাজা। গত বছর জুলাই মাসে নিজের ৬৬তম জন্মদিনে সমর্থক ও স্বজনরা তার বাড়িতে ভিড় জমান। রাজপ্রাসাদ ছাড়ার পর কাঠমান্ডুর শহরতলি মহারাজ গঞ্জের একটি বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন প্রায় তিন হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে। এ সময় তারা রাজতন্ত্রপন্থি স্লোগানও দেয়। তাইতো রাজ সিংহাসন হারানো নেপালের সাবেক এই রাজা নতুন করে স্বপ্ন বুনা শুরু করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, পর্দার আড়ালে জ্ঞানেন্দ্র নতুন কৌশলে ব্যস্ত রয়েছেন। চেষ্টা করছেন সিংহাসন ফিরে পেতে। তার এ স্বপ্ন ফের পূরণ হয় কিনা সেটাই দেখার অপেক্ষা।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

0 comments:

Post a Comment