Breaking News
Loading...
Monday, April 8, 2013

গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২০০-১২৮৭) ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর ইলবেরি তুর্কিজাত সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । সিংহাসনে আরোহণ করার পরে গিয়াসউদ্দিন বলব্ন এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের অপদার্থতার ফলে সুলতানি শাসনের ভিত যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দিল্লির কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে যায় এবং মানমর্যাদা হ্রাস পায় । অন্যদিকে আমির-ওমরাহদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে দিল্লী সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতিতে গিয়াসউদ্দিন বলবন শক্ত হাতে হাল ধরেন ও এক্জন দক্ষ শাসকের পরিচয় দেন । এই পরিস্থিতিকে সামাল দেবার মতো যোগ্যতা গিয়াসউদ্দিন বলবনের ছিল। গিয়াসউদ্দিন বলবনের সময় ‘চল্লিশচক্র’ নামে পরিচিত চল্লিশ জন ক্রীতদাস নিয়ে গঠিত আমীর ওমরাহদের একটি প্রভাবশালী চক্র সাম্রাজ্যের প্রায় সব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করত । সুলতাল নিজে ব্যক্তিত্বশালী ও ক্ষমতাবান হলে এই চক্র তাঁকে মেনে চলতে বাধ্য হত না হলে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে ব্যস্ত থাকত।


(ক) সমস্যা সমাধানের প্রস্তুতি: গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজ ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজ্যে আইন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন । রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্য সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন । তিনি অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব যোগ্য হস্তে অর্পণ করে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন । তারপর তিনি দিল্লী ও দোয়াব অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য মেওয়াটি দস্যুদের দমন করেন । ভবিষ্যতে যাতে তারা পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে না পারে, তার জন্য তিনি গোয়ালিয়রে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন । দোয়াব অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য তিনি কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন ও জালালির দুর্গটি মেরামত করেন ।

(খ) স্বৈরতন্ত্রের আদর্শ ও ক্ষমতার প্রকৃতি: গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁর স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থাকে কায়েম করতে একটি শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক আদর্শ ও তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন । দিল্লি সুলতানির মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহন করেন। পারসিক শাসকদের অনুকরণে তিনি তাঁর রাজসভা গড়ে তোলেন। পারসিক আদব-কায়দা ও প্রথা চালু করে তিনি জনগণের সম্ভ্রম আদায় করেন। তিনি রাজসভায় সব সময় সুসজ্জিত হয়ে ও অনুচরবর্গ দ্বারা বেষ্ঠিত হয়ে প্রবেশ করতেন । রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদের দরজা সাধারণ লোকের কাছে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে লোকের মন ভুলিয়ে এইভাবে তিনি তাদের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব জাগিয়ে তোলেন । সুলতানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন সুলতানের প্রধান কর্তব্য হলো চারটি —যথা

(১) ধর্ম ও শরিয়তের অনুশাসন মেনে চলা ,

(২) অন্যায় কাজ কর্ম বন্ধ করা ,

(৩) ধার্মিক ব্যক্তিকে সরকারি কর্মে নিয়োগ করা, এবং

(৪) ন্যায় বিচার করা ।

তিনি বলতেন “রাষ্ট্রের গৌরব নির্ভর করে এমন এক শাসন ব্যবস্থার উপরে, যা জনগণকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলে” ।



(গ) মোঙ্গল আক্রমণ: আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গল আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, গিয়াসউদ্দিন বলবন দৃষ্টি দেন । তিনি লাহোরের দুর্গটি পুনরায় নির্মাণ করার আদেশ দেন । দীর্ঘদিন ধরে সুলতানের আত্মীয় শের খান যোগ্যতার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন । গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁকে সন্দেহবশত হত্যা করেন বলে বরনি অভিযোগ করেন । এই হত্যাকান্ড গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজনৈতিক অদুরদর্শিতার পরিচায়ক । শের খানের হত্যার ফলে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ হয় । তখন সুলতান জ্যৈষ্ঠ পুত্র মহম্মদকে সুলতানের শাসক নিযুক্ত করেন ও দ্বিতীয় পুত্র বুগরা খানকে সামান ও সুনামের দায়িত্ব দেন । এঁদের যৌথ প্রচেষ্ঠায় সাময়িকভাবে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত হয় । কিন্তু মোঙ্গলরা আবার আক্রমণ করলে মহম্মদ প্রাণ হারান । সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন এই শোকে শেষ পর্যন্ত মারা যান ।



(ঘ) কৃতিত্ব :

(১) যে অবস্থার মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন, তাতে সুলতানকে বাধ্য হয়েই অনেক সময় কঠোর নীতি গ্রহন করতে হয় । সিংহাসনে আরোহণের পর অসীম সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন চরম প্রতিক্রিয়াশীল ‘চল্লিশ চক্রের’ উচ্ছেদ করেন ।

(২) সুলতান হয়ে তিনি একদিকে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যদিকে সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিজের দুই পুত্রকে মোতায়েন করেন ।

(৩) দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলে তিনি মেওয়াটি দস্যুদের কঠোর ভাবে দমন করে রাজধানীর নিরাপত্তা বজায় রাখেন ।

(৪) বাদাউনের নিকটবর্তী অঞ্চলের রাজপুত দুর্গগুলি ধ্বংস করেন এবং রাজপুত জমিদারদের সম্ভাব্য বিদ্রোহ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সেখানে আফগান সৈন্য মোতায়েন করেন ।

(৫) পরবর্তীকালে বাংলার শাসনকর্তা তুঘরিল খাঁর বিদ্রোহ দমন করে গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হন ।

(৬) অভিজাতদের গতিবিধির উপর লক্ষ রাখার জন্য তাঁর আমলে অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয় ।

যাই হোক, যে দৃঢ়তার সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির সুলতানিকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে । তিনি সারা জীবনই অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ পান নি । স্বৈরতন্ত্রী শাসনকে তিনি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করতে পারেন নি । সন্দেহ ও অবিশ্বাস তাঁর বিচারবুদ্ধিকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল । সামরিক দক্ষতার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন তিনি রাখতে পারেন নি । কিন্তু এই সমস্ত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না । তিনি দিল্লি সুলতানির স্থায়িত্ব প্রদান করেন ।

১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর দাস বংশের [Slave dynasty] পতন শুরু হয় ।

0 comments:

Post a Comment