Breaking News
Loading...
Tuesday, April 9, 2013

দিগ্বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন জন্মেছিলেন ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কার্সিকা নামের একটি ছোট্ট দ্বীপে। তিনি ১৭৯৯ সালে প্রথম কনসাল, ১৮০২ সালে আজীবন প্রথম কনসাল এবং ১৮০৪ সালে ফ্রান্সের সম্রাট হন।

নেপোলিয়ন ছিলেন প্রচণ্ড রকমের সাম্রাজ্যবাদী। তিনি ফ্রান্স সাম্রাজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে আক্রমণ করেন একের পর এক রাষ্ট্র, দেশ_ যেমন ইতালি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, বেলজিয়াম, মিসরসহ আরও অনেক দেশ। এসব যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে দুই পক্ষেই মারা যান সহস্র, লাখো মানুষ। ঐতিহাসিক ভিক্টর ডেভিড হানসেন তার বইয়ে লিখেছেন, নেপোলিয়নের ১৭ বছরের যুদ্ধের সময় ইউরোপজুড়ে মারা গিয়েছিলেন ৬০ লাখ মানুষ। দেউলিয়া হয় ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। নেপোলিয়ন যখন রাশিয়ার মস্কো শহরটি আক্রমণ করেন তখন তিনি তার সৈন্য বাহিনীকে বললেন, মস্কো শহরটিকে বল আমার পদতলে এসে আত্দসমর্পণ করতে। তার জনৈক এক সেনাপতি নেপোলিয়নকে জানালেন, শহরে এমন কেউ নেই যে, তার পায়ের নিচে এসে আত্মসমর্পণ করবে। নির্দয় নেপোলিয়ন তার সেই সেনাপতিকে আদেশ দিলেন পুরো শহরে আগুন ধরিয়ে দিতে। তিনি আগুনের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে সঙ্গী সৈনিকদের উদ্দেশ করে বললেন, দৃশ্যটি ভিসুভিয়াসের লাভা উদগিরণের কথা মনে করিয়ে দেয়। চমৎকার তাই না! সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, ভয়ঙ্কর ও বীভৎস দৃশ্য। নেপোলিয়ন নাক কুঁচকে মন্তব্য করলেন, একটা কথা মনে রেখ, কথাটি অবশ্য আমার নয়, এক রোমান সম্রাটের, শত্রুর মৃতদেহ থেকে যে গন্ধ ছড়ায় তা সর্বদাই মধুর।

তার সাম্রাজ্যবাদিতার চেয়ে দুটি মহান কাজের জন্য তিনি অনেকের কাছেই প্রিয় হয়ে আছেন। এই অপরিসীম ক্ষমতালিপ্সু ও নিষ্ঠুর মানুষটির উদ্যোগেই সৃষ্টি হয়েছিল একটি চমৎকার আইন ব্যবস্থা এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য আইন করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠন করে বিশ্বে একটি বাস্তবধর্মী আধুনিক আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন।

নেপোলিয়ন প্রদত্ত আইন ব্যবস্থাটি ছড়িয়ে পড়েছিল অধিকাংশ ইউরোপের দেশগুলোতে এবং সাফল্যের সঙ্গে গৃহীত হয়েছিল ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগাল এবং তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ রাষ্ট্রে। নেপোলিয়নের কোড বইটি ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ!

ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন ব্যবস্থা ছিল না। রাজা কিংবা সামন্ত প্রভুদের প্রচলিত আইনেই রাষ্ট্র পরিচালিত হতো। শুধু ফ্রান্সেই নয়, ইউরোপজুড়েই রাজা ও সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের একটি উক্তি বেশ বিখ্যাত। উক্তিটি হলো, 'এটি আমার ইচ্ছা আর এ জন্যই এটি আইন'। ফরাসি বিপ্লবীরা যখন রাজা ষোড়শ লুইকে হটিয়ে নেপোলিয়নকে সিংহাসনে বসালেন তখন নেপোলিয়নের ওপর দায়িত্ব পড়ল অসম্পূর্ণ আইন ব্যবস্থাটি দ্রুত সংস্কার করে একটি নতুন আইন ব্যবস্থা প্রণয়ন করার।

ফ্রান্সের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন ব্যবস্থা প্রাচীন স্বৈররাজতন্ত্রের পতনের বেশ আগে থেকেই অনিবার্যভাবে অনুভূত হয়েছিল। এর কারণ, একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত হতো। যেমন ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল রোমান আইন দ্বারা ও উত্তরাঞ্চল টিউটনিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো এবং পরিতাপের বিষয় এই যে, উভয় আইন মৌলিকতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ।

ভিন্নতার দিক থেকে ফ্রান্সের আইন ব্যবস্থা শুধু এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এমনকি এক শহর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আর আইনের এই দুরবস্থা দেখে দার্শনিক ভলতেয়ার ফরাসি বিপ্লবের উষালগ্নে জাতিকে উদ্দেশ করে একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, এটা কি অযৌক্তিক এবং ভয়াবহ নয় যে, একই বিষয় একটি গ্রামে যা সত্য এবং অন্য গ্রামে সেটা আবার ভিন্ন আইনের আওতায় মিথ্যা হিসেবে পরিগণিত হয়।

এটি এক ধরনের বর্বরতা যে, একই জাতিকে ভিন্ন ভিন্ন আইনের অধীনে থাকতে হয় এবং একই রাষ্ট্রে যখন কেউ ভ্রমণ করে তখন আইন ব্যবস্থাও পরিবর্তন করতে হয়। যেমনটি একজন হরহামেশাই পরিবর্তন করে তার ঘোড়াগুলো। নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের দীর্ঘ ১১ বছর পর অর্থাৎ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তার তৈরি নতুন কোডগুলো ফ্রান্সে প্রয়োগ শুরু করেন, যা ফ্রেঞ্চ সিভিল কোড নামে অধিক পরিচিত।

তার প্রণীত আইন ব্যবস্থা এতটাই স্বচ্ছ ও সুপাঠ্য ছিল যে, বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ কবি পর্ল ভেলেরি মন্তব্য করেছিলেন_

নেপোলিয়নের কোড বইটি ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। নেপোলিয়নই পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি যিনি কোডগুলোকে সংকলনভুক্ত আইন হিসেবে রূপ দেন। আর তার তৈরি আইনগুলো কমন ল' থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যরূপে প্রকাশ পায়। নেপোলিয়ন তখনকার সামন্ত প্রভুদের তৈরি আইনও বিলুপ্ত করেছিলেন।

এখন জানা যাক, তার ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল। নেপোলিয়ন তার মৃত্যু পর্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে গেছেন। তার দিন শুরু হতো খুব সকালে। ঘুম থেকে উঠেই আগে তিনি প্রেরিত চিঠিগুলোতে চোখ বুলাতেন। প্রয়োজনীয় চিঠিগুলো পড়ে নিতেন প্রথমেই। বাকিগুলো সরিয়ে রেখে দিতেন অন্য একপাশে। এরপর লেগে যেতেন দাড়ি কামাতে। সে সময় রাজা কিংবা সম্রাটদের ব্যক্তিগত নরসুন্দর অর্থাৎ নাপিত থাকত। তারাই দাড়ি কামানোর কাজগুলো সম্পাদন করত। কিন্তু দাড়ি কামানোর কাজটি নেপোলিয়ন নিজ হাতেই করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি রসিকতা করে বলতেন, 'অন্যের হাতের ধারাল অস্ত্রের সামনে নিশ্চিন্ত মনে গলা এগিয়ে দেওয়ার মতো বোকা আমি নই।'

নিজে দাড়ি কামালেও আর্দালি বেয়ারা লাগাত বেশ কয়েকজন। একজন সামনে ধরে রাখত আয়না, কেউবা আবার পানির পাত্র। তিনি সারা ঘরে হেঁটে হেঁটে দাড়ি কামাতেন। এটিই ছিল তার অভ্যাস। দাড়ি কামানোর পর কাজের তাড়া না থাকলে পানিভর্তি চৌবাচ্চায় ডুবে থাকতেন কয়েক ঘণ্টা।

নেপোলিয়নের ভোজনবিলাসিতা নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। নেপোলিয়ন মুরগির রোস্ট খেতে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু সেই রোস্টও হওয়া চাই বেশ গরম গরম। তাই নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত পাচকরা প্রতি ১৫ মিনিট পরপর একটি করে মুরগির রোস্ট তৈরি করে রাখতেন। বলা তো যায় না কখন তিনি তার প্রিয় খাবার চেয়ে বসেন। বলা বাহুল্য, সেসব রোস্টের বেশির ভাগই তার সাঙ্গ ও চেলা-চামুণ্ডাদের পেটে যেত।

তিনি ঘুমোতে যেতেন অনেক রাতে কিন্তু দেরিতে ঘুমোতে গেলেও দু'য়েক ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। গভীর রাতে উঠে আবার শুরু হতো কাজ। শোনা যায় অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার পিঠেই তিনি ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিতেন। ব্যক্তিজীবনে নেপোলিয়ন ছিলেন অত্যন্ত অগোছালো। খেতে বসার সময় জামা-কাপড়ে ঝোল মেখে একাকার করে ফেলতেন। ছুরি, কাঁটা চামচ সামলাতে পারতেন না। খেতে বসে অসাবধানতাবশত হরহামেশাই চায়ের পেয়ালা কিংবা থালাবাসন ভেঙে ফেলতেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত ছুরি, কাঁটা চামচ ফেলে হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করে দিতেন।

নেপোলিয়ন সম্পর্কে একটি মজার ঘটনা দিয়ে। নিপোলিয়ন যে অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন সেটি সর্বজনবিদিত। নেপোলিয়ন মাঝে মধ্যে দিনে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করতেন। তিনি চাইতেন প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তার মতো কর্মদক্ষতা দেখাবে কিন্তু একদিন এক কর্মকর্তা বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় ঝিমুতে শুরু করলেন। নেপোলিয়ন হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ভদ্র মহোদয় এখন মাত্র রাত দুটো অথচ আমি দেখছি আপনারা বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যেই ঝিমুতে শুরু করেছেন। একটা বিষয় মনে রাখবেন রাষ্ট্রের কাজের সময় ঝিমানো চলবে না। রাষ্ট্র থেকে যা মাইনে পাই সেটা বৈধ করে নিতে হবে বৈকি! তার এক অনুরঞ্জক নেপোলিয়নকে খুশি করার জন্য বলে উঠলেন ঈশ্বর নেপোলিয়নকে সৃষ্টি করলেন এবং তারপর বিশ্রাম নিলেন। প্রজাতন্ত্রের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নেপোলিয়নের এমন উদ্ভট কর্মকাণ্ডে যারপরনাই তার প্রতি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন, সে সব কর্মকর্তা-র্কমচারীর মধ্যে থেকে কেউ একজন নিচু গলায় বলে উঠলেন ঈশ্বর আরেকটু আগে বিশ্রাম নিলেই তো আমরা সবাই তার এ অমানবিক অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে যেতাম!

নেপোলিয়নের প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যানটিও বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। নেপোলিয়নের বয়স তখন কেবল ২৬ বছর, টগবগে তরুণ। অনেকটা প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতো অবস্থা হলো নেপোলিয়নের। নেপোলিয়ন যেদিন জোসেফিনকে প্রথম দেখলেন সেদিনই পছন্দ করে ফেললেন তাকে। জোসেফিনের তখন বয়স ৩২ বছর, এক কন্যার জননী ও বিধবা।

জোসেফিনের প্রথম স্বামী ফরাসি বিপ্লবে আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। জোসেফিনের আসল নাম ছিল রোজ। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে নেপোলিয়নের সেই নাম পছন্দ ছিল না। তাই তিনি তার রোজ নামটি পরিবর্তন করে নাম দিলেন জোসেফিন এবং তখন থেকে তিনি জোসেফিন নামেই ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেলেন। জোসেফিনের আগের ঘরের একটি কন্যা সন্তান ছিল, সেই কন্যা সন্তানটিকে এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেন নিপোলিয়নের আপন ছোট ভাই লুইসের সঙ্গে।

ব্যক্তিজীবনে জোসেফিন কিংবা নেপোলিয়ন কেউই কারও প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না। জোসেফিন ছিলেন স্বৈরিণী এবং নেপোলিয়ন ছিলেন বহুগামী। নেপোলিয়ন যখন ইতালিতে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় তার স্ত্রী জোসেফিন অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন চার্লস নামে এক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে। আর এদিকে এসব ব্যাপারে নেপোলিয়নও পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি তখন ইজিপ্টে; তার উপপত্নী ছিলেন পওলিন ফোরেস নামে এক যুবতী। পওলিন নামের ওই মেয়েটি ছিল তার এক জুনিয়র অফিসারের স্ত্রী। নেপোলিয়ন-জোসেফিন দম্পতির কোনো সন্তান না হওয়ায় নিপোলিয়ন উত্তরাধিকার প্রশ্নে জোসেফিনকে ডিভোর্স দেন এবং ১৮১০ সালের মার্চে পুনঃবিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা ম্যারি লুইসের সঙ্গে। ১৮১১ সালে এই দম্পতি একটি পুত্র সন্তান লাভ করে। যার নাম নেপোলিয়ন ফ্রেন্সিস জোসেফ চার্লস। অন্য রাজা কিংবা সম্রাটদের মতো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে নেপোলিয়নের শারীরিক সম্পর্ক থাকার কারণে তার বেশ কয়েকটি অবৈধ সন্তান জন্মেছিল। তাদের মধ্যে চার্লস লিয়ন নামে এক ছেলেকে নেপোলিয়ন তার মৃত্যুর আগে স্বীকৃতি দিয়ে যান।

১৮১৫ সালে বেলজিয়ামের অন্তর্গত ওয়াটার লু যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটনের হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। বন্দী নেপোলিয়নকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে ১৮০০ কি. মি. দূরবর্তী সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দী করে রাখা হয়। ওই দ্বীপেই ইংরেজরা তাকে সুকৌশলে আর্সেনিক প্রয়োগ করে হত্যা করে। সম্রাট নেপোলিয়ন ধীর বিষক্রিয়ায় মারা যান ১৮২১ সালের ৬ মে।

লিখেছেন: সাইফুর রহমান‍~~.!.~~সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

0 comments:

Post a Comment