আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন, তাই আমি সাহিত্যিক হতে পেরেছি। এই উক্তি যিনি করেছিলেন, তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই লিখেছিলেন 'সারেং বৌ' নামের বিখ্যাত উপন্যাসটি। যেটির জন্য তাঁকে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। এই উপন্যাসের স্রষ্টা শহীদুল্লা কায়সার। যিনি তিন পর্যায়ে জেলে আট বছর বন্দি জীবন কাটিয়েছেন এবং এই দীর্ঘ সময়ে পড়াশোনা ও সাহিত্যচর্চা করেছেন নিবিষ্ট মনে। 'সারেং বৌ', 'রাজবন্দীর রোজনামচা', 'সংশপ্তক' ছাড়াও কারাগারে বসে তিনি অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠলে অনেককে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করেছেন তিনি। কিন্তু নিজে দেশ ছেড়ে যাননি।
বাবা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহর প্রথম সন্তান 'আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা', যার সাহিত্যিক নাম শহীদুল্লা কায়সার। তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা-সাহিত্যে সুপণ্ডিত হয়েও তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন। এই পরিবারের পুরুষরা বংশপরম্পরায় পীর বলে পরিচিত ছিলেন। শহীদুল্লা কায়সারের মানস-গঠনে তাঁর মায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন তাঁরই রাজনীতি এবং সাহিত্যিক জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণাদাত্রী।
সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি শহীদুল্লা কায়সারের সাংবাদিক জীবন ছিল অনন্য। নিজের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শ ও ধ্যানধারণার সপক্ষে লেখালেখির সুযোগ পাওয়ায় তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সংবাদ অফিসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সংগ্রামশীল ও আপসহীন। 'কবে হবে বিভাবরী' কারাগারের বাইরে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এটি রচনা করেন। এতে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও ধ্বংসলীলার চিত্র এঁকেছেন তিনি বিরাট এক ক্যানভাসে। চারদিকে হত্যা, ধ্বংস, অগি্নসংযোগের মধ্যে রাত জেগে তিনি এই উপন্যাস লিখতেন। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডুলিপি মাটির তলায় পুঁতে রাখতেন কায়েতটুলীর বাড়িতে। এটি তাঁর শেষ রচনা।
তাঁর প্রথম কারাবাসকালে ১৯৫২-৫৫ সালে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম জেলে তিনি ১৯৫২ সালে 'নাম নেই' ও ১৯৫৪ সালে 'যাদু-ই-হালুয়া' রচনা করেন। তাঁর বিপ্লবী জীবন দর্শনসদৃশ সংশপ্তক উপন্যাসের সূতিকাগার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। সংশপ্তক তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। তবে তৃতীয় প্রকাশিত গ্রন্থ 'কৃষ্ণচূড়া মেঘ' (১৯৫৯), দিগন্তে ফুলের আগুন (১৫ আগস্ট, ১৯৬১), কুসুমের কান্না (২৬-১-১৯৬২ থেকে ১৪-৬-১৯৬২), চন্দ্রভানের কন্যা (অসম্পূর্ণ)_উপন্যাসগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। তাঁর সাংবাদিক জীবনের গ্রন্থ 'পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ' ১৯৬৬ সালে রচিত ও প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। এ ছাড়া কারাজীবনে তিনি অসংখ্য কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, চিঠিপত্র ও নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার কায়েতটুলীর বাসায় আলবদররা স্ত্রী ও বোনের হাতের বাঁধন ছিন্ন করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কারফিউর অন্ধকারে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, এমনকি তাঁর মৃতদেহও পাওয়া যায়নি।
0 comments:
Post a Comment
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.